-তাহলে মেয়েকে আনি।
-বেশি সাজগোজ করাবেন না কিন্তু।
সকলেই হাসল বুলার মার কথায়। বড়বৌ শুধু বলল,
-না, তার দরকার হবে না।
.খাবার সাজিয়ে বসে ছিল রমা। মাধবী ঢুকেই তাড়া দিল। এর মধ্যেই মুখটা চিটচিটে হয়ে গেছে। কাপড়টা গুছিয়ে নিয়ে পাফটা আর একবার ঘষলো। আয়নায় চট করে দেখে নিল কাজলের টিপটা ধেবড়েছে কিনা। ঘর থেকে বেরোবার সময় হঠাৎ মনে পড়ল, প্রথম আলাপে কাবেরী তাকে হাত তুলে নমস্কার করেছিল।
-বুলাকে নমস্কার করবো তো?
ঘাড় নাড়ল মাধবী। আটাশ বছর আগেকার কথা মনে পড়ছে। এমনি করেই ঘাড় নেড়ে মা বলেছিল, হ্যাঁ, নামের আগে কুমারী বলবি আর সবাইকে প্রণাম ক’রে সবশেষে আমায় করবি। রমাকে এসব বলার দরকার নেই, এই প্রথম ওকে দেখতে আসছে না। মাধবীকে একবারই সেজেগুজে নিজেকে দেখাতে হয়েছিল। মা, বৌদি বলেছিল মেয়ের পয় আছে। মা কবে মরে গেছে, বৌদি বিধবা হবার পর আর আসেনি।
রমার চুল টেনে কান দুটো ঢেকে দিল মাধবী। তাদের সময় এমন কান বার করা চুল বাঁধার ফ্যাসান ছিল না। আলতা দেয়নি পায়ে, এর আগেও কোনবার দেয়নি। শুভ কাজেই আলতা পরে। আলতায় লক্ষ্মীছিরি আসে। রমার পায়ের পাতা খুঁটিয়ে দেখল সে। খড়ম পা। নখ কাটেনি অনেকদিন। এখন আর কাটার সময় নেই।
-পা ঢেকে বসবি।
ঘাড় নাড়ল রমা। কোনবার মাধবী পা ঢাকবার কথা বলে নি। তা নিজের পায়ের দিকে তাকাল। থ্যাবড়া, বেঁটে আঙুলগুলো, গোড়ালী চিড় খেয়ে ফেটে গেছে। বোকার মত মাধবীর মুখের দিকে তাকাল সে। আলতা পরে নি ভালই করেছে, তাহলেই ওদের নজর টানত। মাধবী নিঃশ্বাস ফেলল জোরে। আজকাল আর কেউ লক্ষ্য করে না শুভ আচার নিয়মগুলো মানা হচ্ছে কিনা। ভালোই হয়েছে।
-চল।
বুলার হকচকানি ভাবটুকু দেখে মজা লাগল রমার। খুব যেন অবাক কাণ্ড ঘটেছে। কাবেরী যখন নমস্কার করেছিল, তখন কেমন যেন অস্বস্তি লেগেছিল কিন্তু অমন তাড়াহুড়ো করে সে বুকের কাছে হাতদুটো মুঠো করেনি। আঙুলগুলো সরু, কড়ে আঙুলের নখ রঙ করা। তাছাড়া আর সবই তো মেয়েলি।
-বসুন।
বুলা সরে ব’সে খাটের একধারে জায়গা করে দিল রমার জন্য।
-বোসো।
বুলার মা বলল। খুশি হল মাধবী। সভ্যতা ভদ্রতায় রমা পাশ করা মেয়েদের থেকে কম নয়। মনের মধ্যে জ্বলুনিটা কমে এল। ভরসা আসছে, সাহস দিচ্ছে মনটা। নয়, অপছন্দ করল, তবু আড়ালে ওরা রমার নিন্দে করতে পারবে না। মেয়েরও না, মায়েরও না। সংসারের খাটাখাটনিতে রঙটা ময়লা হয়ে গেছে, নয়তো এত কালো রমা ছিল না। কালকেই ব্যাসন মাখিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে দিতে হবে। নরম গলায় মাধবী বলল।
-ভালো করে উঠে বোস।
কাপড়ে পা ঢেকে বসল রমা। সকলে এখন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। কেউ কথা বলছে না। এর আগের বারগুলোতেও এমনি হয়েছে। এই সময়টুকুই ভীষণ খারাপ লাগে। মানুষগুলো মনে মনে তখন তার সম্বন্ধে কি ভাবে কে জানে। এই একটু সময়ের ভালো লাগা মন্দ লাগা দিয়েই তো পছন্দ-অপছন্দের বিচার হবে। কিন্তু পছন্দ করুক আর নাই করুক, সকলে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে ভালোমন্দ যা হোক কিছু একটা ভাবছে, তাই ভাবলেই তো বুকের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, ভার ভার ঠেকে। বিচ্ছিরি লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ে। রাগ করে নিজের ওপর, সকলের ওপর। প্রাণপণ ইচ্ছে হয় চীৎকার করে, লণ্ডভণ্ড করে ছুটে বেরিয়ে যেতে, অন্ধকার সিঁড়ির কোণে ব’সে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে। কিন্তু ইচ্ছেটা যেমন ঝট করে হয় তেমনিভাবেই চলে যায়। পরে আর কিছু মনেই থাকে না। কাবেরীকে দেখে মনে হয়েছিল ঠিকমত লেখাপড়া করলে এতদিনে বি-এ পাশ করে যেতুম। ইচ্ছে হয়েছিল বইপত্তর নিয়ে লেখাপড়া শুরু করতে। ইচ্ছেটা দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ছিল। তারপর কাজের ঝঞ্ঝাটে কি যে হয়ে গেল! এমন কত ইচ্ছে সারাদিনে মনের মধ্যে তৈরী হয়, সব কি পূরণ করা যায়! এখন যদি জানা যেত বুলা তার সম্বন্ধে কি ভাবছে।
রমার নাকের ডগা ঘেমে উঠল, কানের গোড়া গরম লাগছে। আর আশ্চর্য, ক্ষিদে পাচ্ছে। শরীরের ভেতরটা যেন ফুলে ফুলে উঠতে চাইছে, গান ধরছে, আঙুল কাঁপছে। আগুনের মত গরম চা যদি খাওয়া যায় তাহলে হয়তো কমবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে পেটের মাংসগুলো কুঁকড়ে, থরথর করে কাঁপছে। শায়ার দড়িটা আরো শক্ত করে বাঁধলে এই কাঁপুনিটা কমবে বোধ হয়। ওরা কেউ কথা বলছে না, তার মানে খুঁটিয়ে দেখছে। বুলার ব্যাগটা কি মাদুর দিয়ে তৈরী! কাবেরীরটা উড়েদের বটুয়ার মত দড়ি বাঁধা। দেখে হাসি পেয়েছিল। বুলারটায় হাসি পাচ্ছে না। ওদের দু’জনের মধ্যে অনেক তফাত। বুলা কত সাদাসিধে। অনেক লেখাপড়া করেছে। ও নিশ্চয় পটের বিবি সেজে, গল্পের বই নিয়ে জানলার ধারে বসে থাকে না। চাকরির জন্যেই তো লেখাপড়া শেখা। বুলা চাকরি করবে, টাকা রোজগার করবে, ওর বাবার তো অনেক টাকা আছে, তবুও কি চাকরি করবে? কেন করবে না, বাইশ নম্বরে যে ভাড়াটেরা এসেছে, তাদের বাড়ির ছেলেবৌ সবাই রোজগার করে। অনেক টাকা রোজগার হয় ওদের সংসারে, টাকা না হলে কি সুখ আসে। বুলা নিশ্চয় রোজগার করবে, সুখী হবে। সুখী হ’তে তো সবাই চায়। টাকা আছে ওর ব্যাগটায়। তাড়া তাড়া নোট! মুঠো মুঠো পয়সা। কাবেরীর থলেটায় থাকে রুমাল আর খুচরো ক’টা পয়সা। বুলা নিশ্চয় পুরুষ মানুষের মত অফিস করবে দশটা পাঁচটা। রমার চোখ পড়ল বুলার ঘড়িতে। কতোটুকু ঘড়ি, সময় দেখে কি করে? কালো কাপড়ের পটিটায় সুন্দর দেখাচ্ছে কব্জির গড়ন। হাতে একগাদা চুড়ি নেই, ভালোই দেখাচ্ছে বালাটা। সরু হাত!