চেনাশুনো মানুষকে মনে পড়েছে মাধবীর, কিন্তু তবু গিন্নীটিকে পুরো চেনা হচ্ছে না। বুলার বাবা রেলে ভাল চাকরী করত। কাঁচা পয়সা করেছে, বাড়ী করেছে। মেয়ে বৌকে দেখে মনে হয় পয়সা খরচও করেছে। মাধবীর কাছে তারা হেঁয়ালি যারা আজে বাজে জিনিসে পয়সা খরচ করে। কি দরকার বুলার লেখাপড়ার জন্য পয়সা খরচ করে, ওই রোগা মেয়ে কি চাকরী করে সংসার প্রতিপালন করবে, না করার কোনদিন দরকার ঘটবে। পয়সা আছে, ভাল ঘর-বরে পড়বে। কি দরকার পানের বাটাটা রুপোর করার, পেতলেও তো কাজ চলে যায়। এই বাড়তি খরচ করে যারা তাঁদের সত্যিই বুঝতে পারে না মাধবী। ওরা কি বোকা? মাধবী আর একবার স্বস্তি বোধ করল।
-আমার কি খুব মত ছিল নাকি! উনিই বল্লেন, শেষ বয়েসটা গঙ্গার ধারে কাটিয়ে দি, তা’ছাড়া দুবেলা মায়ের চরণও দর্শন করা যাবে’খন। ভাবলুম কথাটা মন্দ না, বয়স তো হলো, তাছাড়া জায়গাটাও বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কোলকাতার অবস্থা যা দিন দিন হয়ে উঠেছে এরপর গরু ভেড়াও আর থাকতে পারবে না। এইসব ভেবে তো মত দিলুম বাড়ি করার। ওমা, দুদিন বাস কত্তে না কত্তেই বুঝলুম কি ঝকমারিই না করেছি, তার থেকে কোলকাতায় পঁচানব্বুই টাকা ভাড়ায় বেশ ছিলুম। কথা বলার একটা মানুষ পাওয়া যায় না! এপাশে এক ষোল টাকার ভিজিটওলা ডাক্তার, ওপাশে এক পেন্সনওলা এস.ডি.ও। গাড়ি নিয়ে ওদের বৌয়েরা তো হরদম কোলকাতা আসছে আর যাচ্ছে, উনি বল্লেন একটা গাড়ি কিনি, আমি বল্লুম, না বাপু অত বড়মানুষি দেখিয়ে আর কাজ নেই।
একটানা বকে যেতে পারে মানুষটা। সরল মানুষেরাই বেশী কথা বলে। যত কুটিল ততই ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়। সরল মানুষকে বশ করতে বেশী বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। মাধবী সহজ সুরে বলল,-যেখানে চিরটা কাল কাটল, তারাই তো বেশী আপনার জন হয়।
-থাকতে থাকতে ওরাও আপনার জন হয়ে পড়তে পারে।
অপ্রস্তুত বোধ করল মাধবী। কথাটা বুলা না বলে যদি তার মা বলত তাহলে অন্যরকম শোনাত।
-তবু, বাঁধন ছিঁড়তে যেমন, গড়তেও তেমনি দেরি হয়।
-সমান সমান হলে দেরি কেন হবে!
বুলার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল মাধবী। ওর চাউনিটা ফলার মত। খচ করে যন্ত্রণা দেয়। বুলার মা জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে, ভাবখানা যেন, যত টাকা খরচ করে মেয়েকে গড়ে তুলেছে, সেই টাকাগুলোকে একসঙ্গে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে। বিরক্তি লাগছে মাধবীর, কিন্তু বিরক্তি জানাবার উপায় নেই। ওদের কথায় সায় দিয়ে চলতে হবে এখন। চলতে হবে রমার মুখ চেয়ে। রমার উপরেও তার বিরক্তি হচ্ছে, ওর জন্যই তাকে মুখ বুজিয়ে ওদের কথা মেনে নিতে হবে।
গোড়ায় সে ভেবেছিল বুদ্ধি দিয়ে লড়তে হবে, আসলে এটা লড়াই করার মত কোন ব্যাপারই নয়, কেননা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লড়াই চলতে পারে না। ওদের কথায় বার্তায়, মন থেকে যে কথাগুলো উঠে আসছে তা বলার স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নিয়েছে। ওরা জবরদস্তি না করলেও জুলুম করছে। অবস্থা বিশেষে মানুষ কিছু কিছু সুবিধা পেয়ে যায়, ওরাও পেয়ে গেছে। এমন সুবিধে মাধবী জীবনে একবারও পায়নি, পাবে কিনা সন্দেহ আছে। দিনেশ গোবেচারা, ওর উপর জুলুম করে লাভ নেই। শক্ত কথা বললে মাথা নামিয়ে থাকে। একতরফা ঝগড়ায় লাভ নেই। মেয়েটা খুব সহজেই বলল, সমান সমান হলে দেরি হবে কেন। সমান হওয়া যেন মুখের কথা। ওরা যেন ইচ্ছে করলেই সমান হবে। দিনেশ কি ইচ্ছে করলেই তার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারবে? এক একটা মানুষ এক এক ধাতের হয়।
-আমিই ওনাকে বল্লুম, লেখাপড়া জানা বৌ নিয়ে কি হবে। দেখেছিতো ঘর-সংসার শ্বশুর-শাশুড়ী ফেলে হুট হুট করে এখান সেখান করে বেড়ায়। তাছাড়া মেয়েরও তো বিয়ে দিতে হবে, তখন লেখাপড়া জানা বৌ কি আর আমার সঙ্গে বসে গপ্পো করবে। তার চেয়ে, ভালো ঘরের নরম সরম মেয়ে আমাদের উপযুক্ত।
-হ্যাঁ, খোকার বৌকে তো আর চাকরি করতে হবে না।
বড়বৌ এতক্ষণ পরে কথা বলল। ও আবার বেশীক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। গোটা বাড়িটার কেউই বোধহয় পারে না, দিনেশ ছাড়া। মাধবীর চোখে পড়ল বুলা ঘড়ি দেখছে। ও ঘরে রমা কি করছে কে জানে। এরাতো কিছুই খাবে না বলছে। মিছিমিছি খাবার কিনে পয়সাগুলো নষ্ট হল।
-খোকার অফিসের পরীক্ষা। পাশ করলেই অফিসার হবে। বলছিল এখন বিয়ে করবে না। এখন বিয়ে করবে নাতো কি চুল পাকলে করবে! আর বিয়ে করলে পর পরীক্ষার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। ফার্স্ট ছাড়া সেকেণ্ড হয় নি কোনদিন, পানটুকু পর্যন্ত খায় না। সেদিন একজন ফটো পাঠিয়েছিল মেয়ের। খোকাকে দেখাতে গেলুম, বলল ওসব তোমরা দেখ, আমি কিছু জানি না। ওনার খুব পছন্দ হয়েছিল। আমার আর বুলার হয়নি, কেমন পুরুষ পুরুষ ভাব।
বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে মাধবীর। স্বামী, পুত্র, পরিবারের উপর অগাধ কর্তৃত্বের গর্বে টসটস করছে বুলার মা। সংসার মাধবীরও আছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে এমন করে বলার সুযোগ তার হবে না। সংসার তাকে বাইরে বলার মত কিছু দেয়নি। সে ভেবেছিল বুদ্ধি দিয়ে লড়বে, ওদের বশ করবে। কিন্তু আক্রমণটা এমন দিক দিয়ে এল, যেখানে কিছুই করার নেই। সংসার তাকে একটা হাতিয়ারও দেয় নি। মাধবী বুঝতে পারে তার হার হয়েছে। লজ্জায় সারা গা জ্বলছে। এখন কিছুই করার নেই। যদি ওদের দয়া হয় তাহলে মেয়ে পছন্দ করবে।