তখন খেতে বসেছে রমা, চিনু যখন বাড়ি ঢুকল রোজকার অভ্যাসমত একবার জিগ্যেস করল, বাবা ঘুমিয়েছে কিনা। হেসে ঘাড় নাড়ল রমা। নিঃশব্দে অন্ধকার ঘরে ঢুকে জামা কাপড় ছেড়ে, লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এসে খেতে বসল চিনু।
রোজকার মতই রান্না। মনীষ আজ চিকেন রোস্ট খাইয়েছে, তাই, ক্ষিদে নেই। ভাতগুলো নাড়াচাড়া করে, থালাটা রমার দিকে ঠেলে উঠে পড়ল।
-খেলে না যে?
-আলুখোসা, কুমড়ো খোসার চচ্চচড়ি কি আর রোজ রোজ ভাল লাগে? ও তুই খা।
-যেমন বাজার আসবে তেমনি রাঁধব তো।
-রাঁধতে জানলে ওই দিয়েই রাঁধা যায়।
-একদিন রেঁধে দেখিয়ে দিও না!
চিনুর পাতের তরকারিগুলো নিজের পাতে তুলে নিল রমা।
-ভাতগুলো জল দিয়ে রেখে দে।
অন্ধকার ঘর থেকে হঠাৎ মাধবীর গলা শোনা গেল। এখনো জেগে আছে। চিনু পান খাবার জন্য ও ঘরে আর ঢুকল না। আলো না জ্বেলে দিনেশের খাটের ধারে মেঝেয় পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
রমা শুতে যাবার আগে চিনুকে পান দিয়ে এল। তখনও সে জেগে।
দুই
-ওরা এসেছে।
কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মাধবী ছুটে এল। পাউডার পাফটা গালে কপালে ঘষছিল রমা। অনেকদিন আগেই পাউডার ফুরিয়েছে, তবু যতটুকু পাফে লেগেছিল তাই ঘষে ঘষে মাখছিল। মাধবীর গলার স্বরে ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার মুখ।
-ওরা এসে গেছে।
চাপা সুরে আর একবার কথাটা বলেই দরজা খুলতে চলে গেল মাধবী। ঘরের দরজা ঘেঁষে, শুধু চোখটুকু বার করে দাঁড়াল রমা।
মোটাসোটা এক গিন্নী। চওড়া কস্তাপাড় শাড়ী, গয়নার থেকেও পান চিবানোর ধরনই বুঝিয়ে দেয় তার অবস্থা স্বচ্ছল। স্বচ্ছল মনে হবার আর একটা কারণ রমার মনে হল, চটি পরে হাঁটার ঢঙটুকুতে। মাধবীর থেকে বয়সে কিছু বড়ই হবে, কিন্তু মাধবী কি চটি পরে অমন নিঃশব্দে হাঁটতে পারবে! গায়ে গতরে ভারী শরীর নিয়ে একমাত্র স্বচ্ছল মানুষেরাই অমন করে হাঁটতে পারে। তাছাড়া খাটিয়ে মেয়েমানুষের গোড়ালি অমন খোসা ছাড়ান আলুর মত হয় না। ওই গিন্নীর পাশে মাধবীকে বিশ্রী লাগল রমার, কিন্তু বুলাকে তার ভাল লাগল।
সংসারে এমন এক আধটা মানুষ আছে যাদের দেখলেই ভাল লেগে যায়। মধুসূদনবাবুকে লাগত। মানুষটা কেমন কেমন যেন ছিল, সরু সিঁড়িতে মেয়েদের মুখোমুখি হলেই হুড়মুড়িয়ে নেমে গিয়ে পথ করে দিত, সারা বাড়ি এই নিয়ে হাসাহাসি করত, রমা হাসত না। অনেকদিন আগে একটা বুড়ো চিনেবাদামওলা আসত, অদ্ভুত সুরে চিনাবাদাম বলে হাঁক দিত, ছোট বেলায় বাবা যেমন করে ডাকত মাথা টিপে দেবার জন্যে! রোজ বিকেলে চিনেবাদামওলার গলার স্বর শুনতে ভাল লাগত। ওর কাছ থেকে বাদাম কেনার জন্য, অফিস যাবার সময় দিনেশের কাছে দুটো পয়সার জন্য বায়না করতেও ভাল লাগত। বাদামওলাটা একদিন দেশে গিয়ে আর ফেরেনি।
মাধবী ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল, সঙ্গে দোতলার জেঠিমা অর্থাৎ বড় বৌও আছে। বুলাকে দেখে ভাল লাগল রমার। মুখখানি ঢলঢলে, মিষ্টি মিষ্টি। বড় বৌয়ের কাছ থেকে ওর কথা সে অনেক শুনেছে, এখন কথাগুলো সত্যি বলে মনে হচ্ছে। অথচ যমুনার কথামত তার ছোট বোনকে মনে হয়নি। সংসারে এমন মানুষও আছে যাদের দেখলেই মন খিঁচড়ে যায়। কাবেরী সেই ধরনের মানুষ। ক’দিনের জন্য দিদির কাছে এসে পাড়ার সব বাড়ির কেচ্ছা কেলেঙ্কারীর খবর জেনে নিয়েছিল। চিনু ঘুর ঘুর করত যমুনার ঘরের সামনে। আর একটা লোক বড় বৌয়ের স্বামী, দেখলেই একগাল হেসে ঘাড়ে হাত রাখবে। লোকটা দিনেশের বয়সী, তবু হাতটাকে নোংরা লাগে।
ওঘর থেকে কথার শব্দ আসছে। কে কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে না। দালানে বেরিয়ে এসে কান পাতল রমা। বুলার মা কথা বলছে, চুরি চামারি করার জন্য চাকরটাকে ছাড়িয়ে দেওয়ার পর সে মাসকাবারি দোকান থেকে আধ মন চাল নিয়ে সটকান দিয়েছে। শুনতে ভাল লাগছে রমার। বুলাকে নিজের হাতে ঘরের কাজ করতে হয় না, চাকর আছে। জেঠিমা বলেছিল, পড়াশুনোয় বুলা খুব ভাল, হপ্তায় তিনদিন মাস্টার আসে, সামনের বার সে বি-এ পরীক্ষা দেবে। সংসারের কাজ শেখার ফুরসত কোথায়! শুনে অবাক লেগেছিল। দেখতে ইচ্ছে করেছিল বুলাকে। কে যেন কথা বলল, বুলা-ই বোধহয়, মেয়ে দেখতে চাইছে। রমার মনে পড়ে গেল, এখনো তার খাবার সাজানো হয়নি। এখনি তো মাধবী আসবে তাকে নিয়ে যেতে।
মাধবীর ইচ্ছে মেয়ে দেখবার আগে মিষ্টিমুখটুকু করিয়ে দিতে। এর আগে মেয়ে দেখবার পর রমাই খাবার নিয়ে আসত। এবার মাধবীর ইচ্ছেটা বদলে গেছে। কেননা, ঠকতে ঠকতে সে এটুকু শিখে নিয়েছে, আগে মানুষকে যাহোক করে ঋণী করে ফেলতে পারলে সে অনেক কিছু বিবেচনা করে দেখতে রাজী হয়। তাই সে অনুরোধ করেছিল যাহোক কিছু মুখে দেবার জন্য। বুলা আর তার মা একসঙ্গে না না করে উঠল। তখুনি মাধবী বুঝে নিল এরাও ঠেকে শিখেছে, ভাল করে না বাজিয়ে কাউকে ঘরে তোলার কথা বিবেচনা করতে বিন্দুমাত্রও রাজী নয়। এদের রাজী করাতে হলে বুদ্ধি খাটিয়ে লড়তে হবে। মনটাকে একটুখানির জন্যেও ঢিলে দিলে চলবে না।
মাধবী খুঁটিয়ে দেখে নিল ওদের। মেয়েটির মুখের গড়ন ভালো হলেও, হাঁ-টা বড়। কথা বলবার সময় মাড়িসুদ্ধ বেরিয়ে আসে। কাঁধটা সরু, হাতের কোন ছিরিছাঁদ নেই। কথাগুলো কেমন কাঠ-কাঠ, আর স্পষ্ট উচ্চচারণের। রমার পাশে ওকে তুলনা করা যায় না। মাধবী মনে মনে অনেকখানি স্বস্তি পেল। কিন্তু মেয়ে পছন্দ করার আসল মালিক বুলা নয়, তার মা। মা-টিকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবু মাধবীর মনে হল যেন সে বুঝে ফেলেছে খানিকটা। হাতে ভর দিয়ে পিছনে হেলে বসার ভঙ্গিটি মৃত্যুঞ্জয়ের পিসীর মত। পিসী বিধবা হবার পর ভাইপোর সংসারেই আছে, দিনরাত হেঁসেলেই কাটে, দুপুর বেলাটায় অমন ক’রে ব’সে গল্প করে। রুপোর পানের বাটাটা কোলের মধ্যে যেমন আগলে নিয়ে বসেছে, তাতে যমুনাকে মনে পড়ল মাধবীর। কোথাও যাবার আগে সাজগোজ দেখাতে আসে যমুনা, তখন ব্যাগটাকে অমন করে কোলে আঁকড়ে রাখে।