এটা সানুর বাতিক। পছন্দমত ছবি কোথাও দেখলেই যোগাড় করে এনে ঘরের দেয়ালে সেঁটে রাখবে। ঘরের এক দিকের পুরো দেয়াল, যতটুকু তার হাত পৌঁছায়, এখন তার দখলে চলে গেছে। ওর বাতিকে কেউ বাধা দেয় না।
দালানে ঝুঁকে পড়ে সানু খোঁজাখুঁজি করে একটা ভাত খুঁটে নিল।
-ফের আবার ওই সব হচ্ছে। আমি কিন্তু মাকে বলে দোব, এঁটো করেছিস। ঘরে লক্ষ্মী আছে না?
-আমিও বলে দোব তুই দালান পরিষ্কার করিসনি, সকড়ি ছিল।
-বলে দেখনা। কে মার খায় দেখব।
কথাগুলোতে কান না দিয়ে সানু ঘরে ঢুকল। ভাত টিপে, ছবিতে মাখিয়ে দেয়ালে সেঁটে দিল। তেল লেগে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গেছে মস্ত এক এরোপ্লেন। এইখানে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পান সাজে মাধবী। এরোপ্লেনটা একটানে ছিঁড়ে ফেলল সে। চুন লেগেছে, মানকড়-পঙ্কজ রায়ের ছবিটায়। খুঁটে ফেলে দিল।
-খালি ছবি আর ছবি! ঘরটাকে কি নোংরা করে রেখেছে। দেব একদিন সব ছিঁড়ে খুড়ে।
দেশলাই নিতে ঘরে ঢুকেছিল রমা। শাসিয়ে উঠল সানুকে। রাগ করল না সানু। এমন শাসানি রমার কাছ থেকে দিনে অনেকবার শুনতে হয়।
রমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সানুর নজর পড়ল ইঁটের ওপর সাজান তোরঙ্গগুলোর তলায়। শালপাতার ঠোঙা উঁকি দিচ্ছে।
দালান থেকে রমা চীৎকার করল।
-চান করে আয় সানু। নইলে কিন্তু আজ আর পাশে শুতে দোব না। গা দিয়ে রোজ ঘেমো টোকো গন্ধ বেরোয়।
উনুন নিয়ে রমা বেরিয়ে গেল। ঠোঙাটা টেনে বার করল সানু। একটা নিমকি আছে। সেটা বাদ দিয়ে গুঁড়োগুলো খুঁটে খেতে শুরু করল।
.-ওতো চাকরি করে, তবে রেস খেলে কেন?
তখন ফুটপাথের মানুষেরা গভীর ঘুমের দিকে চলেছে। চিনু কথাটা জিগ্যেস করল। পার্ক থেকে বেরিয়ে ওরা দুজন হাঁটছিল। চিনু আর অমল।
-ওর বাড়ির অবস্থাও এমন কিছু খারাপ নয়।
-অবস্থা খারাপ হলেই কি কেউ রেস খেলে?
-তাছাড়া আর কি, শিগগির টাকা করার ওর চেয়ে সহজ পথ আর কি আছে?
পার্ক থেকে একটা শুকনো কাঠি কুড়িয়ে এনেছিল চিনু। তাই দিয়ে রেলিঙে খড় খড় শব্দ করল। অমল আঙুল দেখাল রাস্তার ঘুমন্ত মানুষদের।
-ওদের তো খুব টাকার দরকার, কই ওদের কজন রেস খেলে?
-ওদের কথা বাদ দে।
-কেন?
-ওদের আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনি না।
-মনীষের তো বিশেষ অভাব নেই তবে সে কেন খেলে?
-আমার প্রশ্নটাও তাই।
চুপ করে ওরা হাঁটল। শেষ ট্রিপের বাসগুলো পড়িমরি ছুটছে। বাসে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে মানুষ। নিওনের বিজ্ঞাপনগুলো নিভে গেছে। দোকানের আলো আর রাস্তায় নেই। প্রাইভেট মোটরগুলো চোখ খুলে ছুট লাগিয়েছে। ঠেলা গাড়িতে আনাজ চলেছে। ভিড়, বাস টার্মিনাসের চায়ের দোকানটায়।
-মনীষটা দারুণ মেজাজী। এক কথায় কেমন দশটাকার খাইয়ে দিল।
-কালকেই তিরিশ টাকা জিতেছে।
-ও কিন্তু প্রায়ই জেতে। খুব হিসেব করে খেলে।
-হ্যাঁ, খেলার সময় হিসেব করে, কিন্তু খরচ করে দুমদাম।
চিনু দাঁড়াল আগুনের দড়িটার কাছে। সিগারেট ধরিয়ে দড়িটা ছেড়ে দিল। ল্যাম্পপোস্টে আছড়ে কতকগুলো ফুলকি হাওয়ায় ছুটে গেল।
-একদিন ওর সঙ্গে মাঠে যাব।
ধোঁয়ায় রিং করার জন্য চিনু আস্তে আস্তে ফুকল। অমল বিরক্ত হয়ে তাকাল। যারা নেশার জন্য সিগারেট খায় তারা রিং করে না। সাঁই সাঁই টান দিয়ে ধোঁয়া গেলে। অমলের এখন গলা শুকিয়ে গেছে ধোঁয়ার জন্য।
-রেসটাও একধরনের খেলা, উত্তেজনা আছে।
-হবে। আমার কোন ধারণা নেই।
গম্ভীর সুরে অমল বলল। বোঝা যায় আলোচনাটা তার ভাল লাগছে না।
-না হলে বড়লোকরা খেলে কেন?
চিনু জোর টান দিয়ে সিগারেটটা এগিয়ে দিল। আঙুল থেকে তুলে নিল অমল। পরপর কতকগুলো টান দিয়ে ফেলে দিল।
-পরশু যাবি সুভাষদের গ্রামে? অনেকে যাবে। দু’দিন থাকা হবে।
-কত খরচ পড়বে?
-সব মিলিয়ে টাকা দশেকের মধ্যে হয়ে যাবে। চল না, আমিও যাচ্ছি।
-তুই কোত্থেকে টাকার যোগাড় করবি?
-এখন ধার-টার করে ব্যবস্থা করব। পরে শোধ করে দোব।
-তোরা আছিস বেশ। লিখতে জানার এই এক সুবিধে।
-নেহাত বোকা না হলে কোন লেখক উপোসী থাকে না?
হাসল অমল। পকেট থেকে কোঁচাটা ফেলে দিয়ে লাথি মারতে মারতে কিছুটা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল।
-ছুটবি? ওই আলোর থামটা পর্যন্ত।
-পাগল হয়েছিস!
-ছোট না। রাস্তা তো ফাঁকা। চিকেন রোস্টটাও হজম হবে, একসারসাইজও হবে।
-পুলিশে ধরবে।
-ঘেঁচু করবে।
বলেই ছুট লাগাল অমল। অনেক দূরে গিয়ে থামল। সেখান থেকেই চীৎকার করে ডাকল চিনুকে। জোরে হেঁটে চিনু ওকে ধরল।
-গেঁতো মেরে গেছিস।
-কোন মানে হয় না হঠাৎ এভাবে ছোটার।
-তুই বড় মানে খুঁজিস।
আর কথা বলল না অমল। এবার দুজনের রাস্তা আলাদা হবে। চৌমাথাটায় দাঁড়িয়ে চিনু দেখাল গাড়িবারান্দার তলায় একটা ছোট্ট পরিবারকে, ছেঁড়া কাঁথা, মাটির হাঁড়ি, আর কতকগুলো টিনের কৌটো মাথার কাছে রেখে ওরা ঘুমিয়ে।
-ওই ধারেরটার অবস্থা দেখেছিস। কমাস আগে হয়েছে, আবার হবে।
-ঘুমন্ত মেয়েমানুষের চেহারা বিচ্ছিরি ন্যাদগ্যাদে লাগে।
-দিনের বেলা দেখিস, ট্রাম স্টপেজে বসে ভিক্ষে করে। এই খোলা রাস্তায়, আলো জ্বলছে, লোক চলছে, এর মধ্যেই যে কি করে এইসব হয় ভেবে পাই না।
ছেলেমানুষের মত মুখ করে চিনু ভাবনার সমাধান চাইল যেন অমলের কাছে। মুচকি হেসে ওর পিঠে থাবড়া মেরে বাড়ির পথ ধরল অমল।