যতটুকু দেখা যায়, চোখ বুলিয়ে দেখে নিল রমা। ছাতের একধারে গঙ্গার জলের ট্যাঙ্ক। ওপরের ঢাকনিটা অনেকদিন ভেঙেছে। হাত দিলেই ঝুরঝুর করে মরচে খসে পড়ে। তলাটুকু এখনো আস্ত আছে, কাজ চলে যায়।
ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে ছাতটা সরু ফালি হয়ে শেষ হয়েছে পাশের বাড়ির দেয়ালে। ফালি জায়গাটুকুতে কতকগুলো কুঁজো ভাঙা টব। ফুলগাছের জন্য তৈরি হয়েছিল। ফুল ফুটতোও। গাঁদা, বেল, দোপাটি। কেমন যেন পাগলাটে ধরনের ছিল মধুসূদনবাবু। মাঝরাতে বৌকে নিয়ে ছাতে আসত। গল্প করত। একটা ভাঙা সেতার ছিল। বাজাত। সারা বাড়ি হাসাহাসি করত। লুকিয়ে অনেকে দেখত ওদের গল্পকরা। বড় ঘরের ছেলে ছিল মধুসূদন। ঠাকুর্দা ঘোড়ায় চেপে গড়ের মাঠে হাওয়া খেত। ওর বাপ জোয়ান বয়সে জুড়ি হাঁকিয়েছে। একদিন মধুসূদন চাকরি থেকে ছাঁটাই হল। সেতারটা বিক্রি করে দিল। আর একদিন এ-বাড়ি ছেড়ে উঠে গেল বস্তিতে। সে ঘরে এল যমুনারা। সকলে বলল, এবার লোকটার পাগলামি ঘুচবে। রোজ টবে জল দিত মধুসূদন। এখন মাটি পাথুরে।
টবগুলো পার হয়ে বিশ্বর জানলার ধারে দাঁড়াল রমা। তিন দিক দেয়াল ঘেরা ছাতের এই ছোট্ট জায়গাটা প্রায় একটা লুকোন ঘরের মত। ভাঙা ট্যাঙ্ক, দেয়াল আর আকাশ।
রমা সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখল ঘরে কে! অবশ্য বিশ্ব ছাড়া আর কারুর থাকার কথা নয়। ঘরটা এত ছোট যে ঠাকুরঘর ছাড়া আর কোন কাজে লাগে না। ওই জন্যই বোধ হয় তৈরি হয়েছিল। এখন ও ঘরে সংসারের একমাত্র পুরুষ বিশ্ব থাকে।
চা খাচ্ছিল বিশ্ব। বিছানাটা একধারে গোটান। তার ওপর ছেড়ে রাখা জামাটা আর বই-খাতা; ভাঁড়ে বিড়ি সিগারেটের টুকরো। দেয়ালে কাত হওয়া সুভাষ বোসের ছবি। ঘরের দরজা বন্ধ।
একচিলতে কপাল জানলা থেকে সরে যেতেই বিশ্ব চায়ের কাপ হাতে উঠে এল।
-খুব সাহস হয়েছে দেখছি। মা বুঝি এখন বাড়ি নেই?
-যাবে কোথায়!
রমা তবু ছাদের দিকে তাকাল। বিকেল হয়েছে। ছাতে কেউ উঠে আসতে পারে। সিঁড়িতে কারুর পায়ের শব্দ হয় কিনা শোনার জন্য কান পাতল।
-শুনলুম, আজ দেখতে আসার কথা আছে?
-দেখা হয়ে গেছে।
-ও। কি হল?
-পছন্দ হয় নি।
শুকনো স্বরে বলল রমা। চায়ের বাটি মুখের কাছে তুলেও চুমুক দিল না বিশ্ব।
-রোজ একধরনের খোঁপা বাঁধ কেন?
-তাতে কি হয়েছে?
-দেখতে ভাল লাগে না।
-হাঙ্গামা অনেক।
-ও। চা খাবে?
বাটিটা এগিয়ে ধরল বিশ্ব। জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে গলবে না বাটি। কাত করে চুমুক দিতে হবে।
-না।
-না কেন?
-ভাল লাগছে না।
-হঠাৎ।
আর কথা বাড়াল না রমা। পুরুষ মানুষের একঘেয়ে অনুরোধ সবসময় ভাল লাগে না। রাজী না হলে বিশ্ব এখন ঘ্যান ঘ্যান করবে।
বাটিটা গরাদের ফাঁকে ধরে চুমুক দিল রমা! চা’টা জুড়িয়ে গেছে। বোধ হয় বিশ্ব বাড়িতে ঢোকার আগেই তৈরি হয়েছিল। জুড়োন চা একদম ভাল লাগে না। এক চুমুক দিয়েই রমা মুখ সরিয়ে নিল।
-আমার এঁটো চা খেলে তো!
এমনি ভাবে প্রথম দিন চা খাওয়ার পর বিশ্ব ভয় দেখিয়েছিল। ঝাঁঝিয়ে উঠে রমা বলেছিল,-আচ্ছা, আচ্ছা, টি-বি হয়তো আমার হবে, তাতে তোমার কি। ঠাট্টা করতে করতে সত্যি যেদিন হবে, সেদিন বুঝবে।
আজ রমা চুপ। শুধু বিশ্বর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চা-টুকু এক চুমুকে শেষ করল বিশ্ব।
-মন খারাপ বুঝি?
-কেন?
-পছন্দ করেনি বলে।
-তাতে মন খারাপের কি আছে?
আগের বার যখন রমাকে দেখে অপছন্দ করে যায় তখন ঠাট্টা করেছিল বিশ্ব। ঠোঁট উলটিয়ে রমা বলেছিল,-হ্যাঁ, পছন্দ করবে না আর কিছু। কালো কুচ্ছিতকে কে বিয়ে করবে।
-তাহলে মন খারাপ হয়নি। তবে কথা বলছ না যে?
একটু যেন অভিমানী সুর বিশ্বর। কি কথা বলবে ভেবে পেল না রমা। মনের ওপর অসহ্য চাপ পড়েছে। চাপটা সরে গেছে। এখন আছে শ্রান্তি, মন জিরোতে চায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে।
-জানো মা উঠে পড়ে লেগেছে। এবার গেছে দোতলার জেঠিমার কাছে। ওর কে যেন আছে। ভাল চাকরি করে।
চুপ করে রইল বিশ্ব। সেদিনকার মত ঠাট্টা করে বলল না,-আমিই না কি এমন বেকার। হা-পিত্যেশ করে জানলার ধারে তাকিয়ে বসে থাকাটাও তো একটা কাজ!
-অনেক জায়গায় দরখাস্ত করেছি।
আপন মনে বিড়বিড়িয়ে কতকগুলো কথা বলে গেল বিশ্ব। তারপর সব কথা ফুরিয়ে গেল।
-সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
-হাঁ।
-উনুন ধরাতে হবে, সন্ধ্যে দেখাতে হবে, চলি।
কথাটা বলেও একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রমা। তারপর নিচে নেমে গেল।
দিনেশ একা বই পড়ছে ঘরে। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। আলো জ্বালবার কথাও ভুলে গেছে। সুইচ টিপতেই চোখ খুলল দিনেশ। বই পড়েনি, চোখ বুজিয়ে বসে ছিল।
-মা কোথায়?
-এই তো দোতলায় গেল।
-তুমি বেরোবে না!
-কোথায় যাব?
-র’কে গিয়ে তো বসতে পার।
-ভাল লাগে না।
-তা হলে পার্কে।
-আচ্ছা যাচ্ছি। উনুন ধরেছে?
-চা খাবে তো!
উনুন ধরাবার তোড়জোড় শুরু করল রমা। তোলা উনুনে কয়লা সাজিয়ে উঠোনে গিয়ে আগুন দিতে হয়। নইলে ধোঁয়ায় ঘরে তিষ্ঠোন যায় না। এ বাড়ির সকলেরই তোলা উনুন।
কাঠ সাজাচ্ছিল রমা। সানু এসে পাশে দাঁড়াল। বিকেল হতে না হতেই সে বেরিয়েছিল বল খেলতে।
-মা কোথায় রে?
-দোতলায়।
সাবধানে কয়লা ফেলতে ফেলতে রমা বলল। ঘরে ঢুকেই গজগজ করে উঠল সানু।
-আমার ছবিতে কে হাত দিয়েছিল। ছিঁড়ে গেছে।
-কোন ছবিটা?
রাস্তার পোস্টারের একটা ছেঁড়া টুকরো এনে দেখাল সানু। সার্কাসের পোস্টার। একটা সিংহের মুখ, বিকট হাঁ করে আছে।