শ্যামসুন্দরের ক্যান্টিনের সামনে চার-পাঁচজন দাঁড়িয়ে ঘুগনি আর সেঁকা পাঁউরুটি খাচ্ছে। প্রিয়ব্রতকে দেখে দেখে ব্যস্ত শ্যামসুন্দর চেচিয়ে বাচ্চচাটাকে বলল, ”অতুলবাবুকে চা দে।”
”না, চিনি দেওয়া চা আর খাব না।”
”চিনি ছেড়ে দিলেন!”
”হ্যাঁ।”
”খুব ভালো করেছেন…ওরে চিনি ছাড়া এক কাপ বাবুকে করে দে।”
প্রিয়ব্রত সরে গিয়ে বারান্দার কাছে দাঁড়াল। রোদের হলকায় বাইরের দিকে তাকানো যাচ্ছে না অথচ সে এতক্ষণ রাস্তায় হেঁটে বিন্দুমাত্র গরম বোধ করেনি! হাওয়ায় ঘামে ভেজা ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা লাগছে। গেঞ্জিটা সেঁটে রয়েছে চামড়ার সঙ্গে। আজও মেঘ নেই কিন্তু হঠাৎই বিকেলের দিকে আকাশ কালো করে এসে যায়।
চায়ের কাপ বাচ্চচাটার হাত থেকে নিয়ে সে প্রথম চুমুক দিয়েই অদ্ভুত অপরিচিত স্বাদ পেল। কষা পাঁচনের মতো। ছোটোবেলায় ম্যালেরিয়া হতে জ্যাঠামশাই কোবরেজমশায়ের কাছে নিয়ে গেছলেন। পেটে চারটে আঙুল দিয়ে খোঁচাখুচি করে পীলের অবস্থা পরীক্ষা করে পাঁচন আর কী একটা বড়ি আনারস পাতার রস দিয়ে-
”অতুলদা আপনি এখানে?” ভৌমিক দোতলা থেকে উঠে এসে, তাকে দেখে এগিয়ে এল। ”আপনার একটা ফোন এসেছিল সজল দত্তের কাছে। আমি উঠে গিয়ে কথা বললাম।”
”ফোন! আমার!” প্রিয়ব্রতর বুকের মধ্যে বরফ জমে উঠল। ছাব্বিশ বছর চাকরিতে এই প্রথম। নিশ্চয় খারাপ খবর।
”কে করেছিল? কীজন্য? কী বলল?”
”আপনার ছেলে।”
”হিতু! কী হয়েছে ওর?”
মোটরবাইক অ্যাকসিডেন্ট! ঝলকের জন্য তার চোখে ভেসে উঠল দলাপাকানো রক্তাক্ত হিতু।
”একটা খবর আপনাকে জানিয়ে দিতে বলল। নিরু নামে একটি মেয়ে, আজ এগারোটার সময় কলঘরে গায়ে আগুন লাগিয়েছে। হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, সম্ভবত বাঁচবে না।”
প্রিয়ব্রত একদৃষ্টে তাকিয়ে ভৌমিকের মুখের দিকে। মুখের পেশি অচঞ্চল। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেও কোনো পরিবর্তন ঘটল না। ভৌমিক আশ্বস্ত স্বরে বলল, ”আত্মীয়টাত্মীয় নয়।”
”না।” প্রিয়ব্রত চুমুক দেবার জন্য কাপটা তুলে আবার নামাল। ”পিছনের বাড়ির একটা মেয়ে।”
”প্রেমঘটিত?”
”না।”
”তাহলে আর কীসের জন্য?”
জবাব না দিয়ে প্রিয়ব্রত এগিয়ে গেল। শ্যামসুন্দরের টেবিলে আধখাওয়া চায়ের কাপ রেখে অফিস ঘরের দিকে যেতে গলা নামিয়ে ভৌমিককে বলল, ”খুনও তো হতে পারে।”
নিজের চেয়ারে বসে প্রিয়ব্রত মাথা নিচু করে একদৃষ্টে টেবিলে রাখা ফাইলের দিকে তাকিয়ে রইল। কানের পাশে যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। ভিজে গেঞ্জি শুকিয়ে চামড়া টেনে ধরছে। সে ড্রয়ারে চাবি ঘুরিয়ে টেনে খুলল। উপরেই রয়েছে সাদা খামটা। নিরাসক্ত চোখে সে খামটার দিকে তাকিয়ে রইল।…কিন্তু কেন? কেউ ওকে খুন করবে, কী উদ্দেশ্যে, মোটিভ কী? বীতশ্রদ্ধ হয়ে, ঘেন্নায় কি নিরু চলে যেতে চেয়েছে! ভিতু, কাপুরুষ লোকগুলোই কি ওকে…কাপুরুষ একটা লোকই কি…!
কিছুক্ষণ পর সে খামটা তুলে ভিতর থেকে একশো টাকার পাঁচটা নোট বার করে পকেটে রাখল। তারপর শান্ত হাতে একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে ডান হাতটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে কলম তুলে নিল।…নিরুর তো আত্মহত্যা করার কথা নয়।…’প্রাণের মায়া তো সবারই আছে, তাই না?’ ও তো তাই বলেছিল।
এইবার সে মন দিয়ে তার কাজটা শেষ করে ফেলতে চায়। এখন সে কোনোদিকে তাকাবে না। কোনো কথা কানে ঢোকাবে না। তার ইন্দ্রিয়ের সবকটা দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে কাজ করবে। ছাব্বিশ বছরের জমানো কাজ সে আজই শেষ করবে। মুখ ফিরিয়ে দরজা দিয়ে তাকিয়ে, শেষবারের মতো আকাশটা যেন দেখে নিয়ে প্রিয়ব্রত শুরু করল: ”মাননীয় ডিরেক্টর মহাশয়-
অফিস ছুটির আধঘণ্টা আগে সে দরজার কাছে গৌরাঙ্গকে দেখতে পেল। মুখে সরল, অপ্রতিভ হাসি নিয়ে ঘরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে। প্রিয়ব্রতর মুখের পেশি সামান্য নড়ে উঠল। ভৌমিক একবার চোখ তুলে দেখল।
”কেমন আছেন?”
”ভালো…খুব ভালো।” প্রিয়ব্রত হাতের কাজ বন্ধ করল। ঘড়ির দিকে তাকাল।
”একটু দেরি হয়ে গেল আসতে। বাস ট্রামের যা অবস্থা!”
”হ্যাঁ, খুবই অসুবিধা হয়।”
গৌরাঙ্গ বোধহয় আশা করেনি প্রিয়ব্রতকে এমন সমাহিত ধীর দেখবে। ঝুলে পড়া চোখের পাতার তলা থেকে নজর বার করে আনার চেষ্টায় তার কপালে ভাঁজ পড়ল।
”ইতিমধ্যে আপনি কিছু কি ভাবলেন?” গৌরাঙ্গ গলা নামিয়ে বলল।
”হ্যাঁ ভেবেছি।”
তার কথার প্রতিক্রিয়া গৌরাঙ্গর মুখে দেখার জন্য সে তাকাল না। সাদা খামটা দু’আঙুলে শুধু তুলে নিল। সে আন্দাজ করতে পারছে এই খামটা দেখে ওর মনের মধ্যে কী ঘটছে।
প্রিয়ব্রত ঘরের সর্বত্র তাকাল। শেষবারের মতো সে যেন ছবি তুলে নিচ্ছে তার ছাব্বিশ বছরকে স্মৃতির অ্যালবামে রাখার জন্য।
”আপনি বসুন, আমি আসছি।”
প্রিয়ব্রত সাদা খামটা হাতে নিয়ে উঠল। মন্থর গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় এল। ডিরেক্টরের ঘরের দরজার পাশে বেঞ্চে বসে সুখেন্দু। তার পাশে বসে একটি যুবক ভিজিটিং স্লিপে নাম লিখছে।
”সুখেন্দু এই চিঠিটা সাহেবকে দিয়ে এসো।”
”ভেতরে অ্যাকাউন্টসের দীপকবাবু খুব আর্জেন্ট চিঠি কি?”
”ন আ আ।”
প্রিয়ব্রত ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসল। গৌরাঙ্গ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে। এতক্ষণে নিশ্চয় চিঠিটা পড়া হয়ে গেছে। মাত্র এগারোটা লাইন। পড়েই চমকে উঠবেন। বেল বাজাবেন। সুখেন্দু ঘরে ঢোকামাত্র বলবেন…।