সারা বাড়িটায় গুণগুণ একটানা আওয়াজ। নিজের চেয়ারে বসে কখনো সেটা কানে লাগেনি। রাস্তায় বেরিয়ে এসে প্রিয়ব্রত মুখ তুলে তার অফিস বাড়িটাকে দেখল। দেখতে দেখতে তার মনে হল, অতি সাধারণ একটা পুরনো বাড়ি। এর মধ্যে যে একটা সরকারি দপ্তর, তাতে শ দুয়েক লোক কাজ করছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে না। এই বাড়িতে প্রতিদিনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সে জমা দিয়ে গেছে। বিনিময়ে পেয়েছে জীবনধারণের জন্য কিছু টাকা। কোনো সম্পর্ক সে বাড়িটার সঙ্গে খুঁজে পেল না।
রাস্তা দিয়ে আপনমনে অভ্যাসমতো হেঁটে সে মৌলালির মোড়ে এসে থমকে গেল। ছুটি হয়ে গেছে নাকি! যাচ্ছি কোথায়? কেন এখন বেরোলাম অফিস থেকে?
দ্রুত ধাবমান ট্রেনের আলোর মতো প্রিয়ব্রতর চেতনার উপর দিয়ে পিছলে গেল প্রশ্নগুলো। চটকা ভাঙা চোখে তাকিয়ে দেখল সে একটা লেদ মেশিনের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। এই দোকানটার সিঁড়িতেই তো সে বৃষ্টির সময় সেদিন উঠে দাঁড়িয়েছিল!
তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে সে রাস্তা পার হবার জন্য পেভমেন্টের কিনারে দাঁড়াল। খুদিকেলো বা নিরুর সঙ্গে আর তার দেখা হবে কি না সে জানে না বা দেখা হলেও তারা নিশ্চয় আর কথা বলবে না। কিন্তু স্মৃতি তাকে তাড়া করবে।
প্রিয়ব্রত রাস্তা পার হল। এখন তাকে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অফিসে ফিরতে হবে। আবার ওই ভৌমিকের চোরা চাহনি আর সজাগ কানের আওতায় গিয়ে বসতে হবে। আবার স্বদেশ এসে সবজান্তা মাতব্বরি চালে তাকে উপদেশ দেবে। ‘ডেঞ্জারাস লোক’, সবার হাঁড়ির খবর রাখে, কে বয়স কমিয়ে চাকরি করছে তাও হয়তো জানে! কে নাম ভাঁড়িয়ে অন্য লোকের নামে চাকরি করছে, সেটা জানতে ওর ক’দিন সময় লাগবে?
গৌরাঙ্গ কবে আসবে, সেটা কি যাবার সময় বলে গেছে? আজও আসতে পারে, নয়তো কাল। ‘বাবা বলে গেছেন ততদিনই আপনি দেবেন।’ ততদিন মানে ভনভন করে উঠেছিল। চোখের পাতা উঠে গিয়ে মণিদুটো অস্বাভাবিক বড়ো হয়ে গেছল। শেষ পর্যন্ত বিনয় দেখিয়ে যাবে। দিনের পর দিন আসবে আর তাকে কোণঠাসা করবে ধীর নম্র ভঙ্গিতে। শুধু মনে করিয়ে যাবে, মাসকাবারিটা দিয়ে দিলে ‘আপনার মঙ্গলই হবে।’ থমকে দাঁড়িয়ে প্রিয়ব্রত স্টপে এসে দাঁড়ানো বাসটার দিকে তাকাল।
ভিতরে ঠাসাঠাসি যাত্রীরা। লোক যত নামল ততজনই প্রায় উঠল। লেডিজ সিটের সামনেও এক হাত তুলে রড ধরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা। শাঁখাপরা হাতে থলি আঁকড়ে দাঁড়ানো বউটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ব্রতর মনে হল, ওর দু চোখে চাপা বিরক্তি। মুখটা ঘুরিয়ে পিছনের লোককে কিছু বলল। বাস ছেড়ে দিয়েছে। যতদূর সম্ভব সে বউটিকে দেখার চেষ্টা করল। রাগতমুখে কথা বলে যাচ্ছে। এই ভিড় বাসে ওর পিছনে দাঁড়ানো পুরুষমানুষটি কি বাঁ ঊরু দিয়ে পাছায় চাপ দিয়েছে?
কিন্তু আমি তো নই, নিরুই স্বেচ্ছায় করেছিল। বাসের দোলানি আর ঝাঁকানিতে চাপটা এক-এক সময় শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়ব্রত তখন ধাঁধায় পড়ে গেছল। তার খোলসে এমনভাবে আঘাত আসতে পারে সে ভাবেনি। সত্যিই সে ভয় পেয়ে নিজের জগৎটাকে রক্ষা করার জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়। ‘হয় না হয় না, তুমি এখনও ছেলেমানুষ, ঠিক বুঝবে না অসুবিধেটা কোথায়…এখন বাড়ি চলো।’ অসুবিধেটা কী ছিল? এইসময়েই তো জীবনটাকে মদের মতো চুমুকে চুমুকে খাওয়ার কথা।
একটা বড়ো রকমের ভুল সে করে ফেলেছে। জীবনে আর এমন সুযোগ হয়তো আসবে না! নিরু তাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এটাই সে বুঝতে পারেনি। হিতু বলেছিল, কেউ কি ওকে বিয়ে করতে রাজি হবে?…’তোমাকে বললে কি-?’ একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত…বাবাকে জীবন উপভোগ করিয়ে দেবার জন্য ছেলের চেষ্টা! হিতু নিশ্চয় তাকে লক্ষ করেছে যেমন বিশ্বজিত গুপ্তাকে সিডনি থেকে নজরে রেখেছিল জন ট্যালেন্ট। নিজের সাহস নেই তাই ছেলে সাহস জুগিয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে।…ভিতু।
প্রিয়ব্রত উদভ্রান্তের মতো এধার ওধার তাকিয়ে মাথা নিচু করে এবং ট্র্যাফিক উপেক্ষা করে বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পার হল। চা খেয়ে ছুঁড়ে দেওয়া মাটির ভাঁড়টা তার দু হাত সামনে পড়ে চৌচির হয়ে গেল। প্রিয়ব্রত মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই লোকটি কাঁচুমাচু মুখে অস্পষ্ট স্বরে কিছু বলল।
ফণী পাল থাকলে ছড়িটার ডগা দিয়ে টুকরোগুলো সরিয়ে দিত। ফণী পাল নিজেই সরে গেছে। কিন্তু তার বদলে রেখে গেছে ঝুলি কাঁধে একজনকে। গৌরাঙ্গ আজ হয়তো আবার আসবে। ভৌমিক কান উঁচিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করবে। সে ঘড়ি দেখবে আর ড্রয়ার টেনে সাদা খামটার দিকে তাকাবে। কুড়ি বছর ধরে ফণী পাল, পাঞ্জাবির বোতাম খুলে, খামটা ভাঁজ করে দুবারের চেষ্টায় ভিতরের পকেটে ঢোকায়। গৌরাঙ্গ কি সেইভাবেই বাবাকে অনুসরণ করবে? ওর খদ্দরের পাঞ্জাবিটায় কি ভিতরের পকেট আছে!
সারা অফিস একইভাবে গুনগুনিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দোতলার ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে সে ডিরেক্টরের ঘরে দিকে তাকাল। পর্দাটা শান্তভাবে ঝুলছে। পর্দার তলা দিয়ে একজোড়া জুতো দেখা যাচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কার পা? জুতোদুটো অনেকটা তারই জুতোর মতন। সে ওইখানে দাঁড়িয়ে ডিরেক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো কিছু কি বলেছে?