কিন্তু আমি তো প্রাণপণে হুঁশিয়ার থাকার চেষ্টা করেছি। কখনো তো হিতুর উপস্থিতিতে ঘরের জানলায় পর্যন্ত দাঁড়াইনি, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অশোকবাবুর ঘরের দিকে তাকাইনি! ঘরের কাজের জন্য মেয়েমানুষ রাখিনি কিন্তু রাখতে পারতাম। পাড়ার অনেক বাড়ির কর্তার সম্পর্কে তো ঝি-কে জড়িয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। যাদের নিয়ে কথা হয়, তারা সেসব তো কখনো গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। সেও আনত না। কিন্তু তবুও সে…।
”আরে অতুলদা, আপনি তো দেখছি পরীক্ষার পড়ার মতো ফাইলই পড়ে যাচ্ছেন। অত চিন্তা-ভাবনার কি আছে? ডায়বেটিস তো কোটি কোটি লোকের আছে। আমার থাকতে পারে, ভৌমিকদারও থাকতে পারে। আমরা ব্লাড টেস্ট করাইনি তাই জানতে পারছি না, আপনি করিয়েছেন তাই ধরা পড়েছে।”
ধরা পড়েছে? প্রিয়ব্রত ভ্রু কোঁচকাল। কিছুর কি ইঙ্গিত দিল?
”ধরা পড়ে তো ভালোই হল। এবার রোগটাকে বাগে রাখতে যা যা করার দরকার করতে পারবেন।”
স্বদেশ কি ইঙ্গিতটা আরও স্পষ্ট করল? গৌরাঙ্গর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওরা ঘরের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করেছিল। গৌরাঙ্গর কাছ থেকে সবই জেনে নিয়েছে। নিশ্চয় আজ বা কালই ওরা স্টাফ সেকশানে গিয়ে তার সার্ভিস ফাইলটা দেখতে চাইবে। দেখানোর নিয়ম নেই কিন্তু ওখানে ওদের লোক আছে। তারপর ইউনিনের দু-তিনজনের সঙ্গে ফিসফিস কথা হবে। ‘অফিসে কখন যে কীসে ফেঁসে যাবেন আপনি তা জানেন না।’
জানব না কেন। আমি নিজেই তো নিজেকে ফাঁসিয়ে ফেলেছি। নিরু থানায় বসে বলল আমি ভিতু, কাপুরুষ।
”ভৌমিকও আমাকে তাই বলল। খাওয়া-দাওয়ায় সাবধান হতে হবে, জোরে জোরে মাইলখানেক হাঁটতে হবে, করলার রস খেতে হবে।”
কিন্তু কেন? একটা ভীরু, যে পালাতে চায় কিন্তু একা পালাবার সাহস নেই তাকে হার্ট ডিজিজ হওয়া থেকে মুক্ত রাখার কি কোনো দরকার আছে?
”আপনি কি সকালে ঘুম থেকে উঠে উইক ফিল করেন?”
স্বদেশ কি প্যাঁচালো কোনো নোংরা ইঙ্গিত করল? সেকস? ‘এই ঘরেই আমি থাকব, থাকতে ঠিক পারব।’ নিরু কী ভেবে কথাটা বলেছিল? কথাটা কি বাঁচতে চাওয়ার জন্য বেপরোয়া তাগিদে বলা, নাকি….বুঝতে আমিই ভুল করেছিলাম।
প্রিয়ব্রত জিজ্ঞাসু চোখে ভৌমিকের দিকে তাকাল। ”কিছু বললে?”
”হ্যাঁ। বলছি কি, আপনি মাসখানেকের ছুটি নিন, কখনো তো নিলেন না। কত মাসের আরন লিভ নষ্ট করেছেন তার হিসেব রেখেছেন?”
”না।”
”ন্যায্য পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে না নেওয়া, এটাকে কী বলবেন?” স্বদেশ তার হতাশা, অনুযোগ আর বিরক্তি একসঙ্গে প্রকাশ করতে চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে দিল, মাথার পিছনে হাতের দুই তালু রাখল। চোখে ঈষৎ বিদ্রুপ এবং কাঠিন্য।
”এটা তো আপনার অর্জিত পাওনা, ভিক্ষে করে তো এই ছুটি নিচ্ছেন না? দয়া করেও গভর্নমেন্ট ছুটি দিচ্ছে না।…এই ধরনের গোলামির কোনো মানে হয় না। ছুটি চাইলে কি ভেবেছেন গভর্নমেন্ট চটে গিয়ে আপনার চাকরিটা খেয়ে নেবে?
”না না…আসলে ছুটির কোনো দরকারই হয়নি, তাই।”
স্বদেশ কি বলতে চায়? চাকরি যাবার ভয়ে এত বছর ধরে ছুটি নিইনি! ভীরুতা? প্রিয়ব্রত কানের উপরে গরম ছুঁচ ফোটাবার মতো যন্ত্রণা বোধ করছে।
”কুড়ি-পঁচিশ বছর আপনার কখনো আরন লিভ নেবার দরকারই হয়নি!” ভৌমিক তাকাল প্রিয়ব্রতর দিকে নয়, স্বদেশের দোমড়ানো ঠোঁটের দিকে।
”একইভাবে, তার মানে এত বছর কাটিয়ে এসেছেন!”
”হ্যাঁ।”
হিতু কি যেন বলেছিল? ‘একইভাবে চাকরি করে গেলে, একই চেয়ার টেবিলে বসে…আমি জ্ঞান হওয়া থেকে তোমায় দেখলুম শুধু গঙ্গাজলই খেয়ে গেলে, নিজেকে একটু ঝাঁকাঝাঁকিও করলে না।’
নিজেকে ঘিরে ছাব্বিশ বছর ধরে খোলস বানিয়ে সে তার মধ্যে নিজের একটা জগতে বাস করে যাচ্ছে। সেই জগতে যা কিছু স্পর্শ করেছে তাতেই ভয়, যা কিছু দেখেছে, শুনেছে তাতেই ভয়। শীতল অন্ধকার খোলসটার সঙ্গে কী চমৎকার সে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে ফেলেছে। কাউকে জানতে দেয়নি তার বসবাসের ঠিকানা। সেই খোলসটা এখন কেটে গিয়ে তাকে হুমকি দেওয়া, মারমুখী একটা বাইরের জগতে ঠেলে দিচ্ছে।
”অতুলদা আপনার কি একবারও ইচ্ছে করেনি দিঘা বা দার্জিলিং বেড়িয়ে আসতে?”
”না।”
অতুল ঘোষের করেনি কিন্তু প্রিয়ব্রতর করে। ‘আমার মনে হয়েছিল উনি পালাতে চান।’ প্রিয়ব্রত এখনও বুঝে উঠতে পারেনি, নিরু বলল কেন তাকে নিয়েই পালাতে চাই? মেয়েদের কি ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম পর্যন্তও ইন্দ্রিয় আছে। কোথায় পালাতে চাইবে…দিঘা, দার্জিলিং?
ভৌমিক আর স্বদেশের মধ্যে যে চোখাচোখি হল, প্রিয়ব্রত না তাকিয়েই সেটা বুঝে নিল। ওরা আর তার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখাল না। একটু পরেই স্বদেশ উঠে চলে গেল।
”ভৌমিক, আমি বরং একবার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে আসি।” প্রিয়ব্রত উঠে দাঁড়াল। অসহ্য লাগছে তার এই পরিবেশ। এই চেয়ার টেবিল ফাইল, আধা অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে মাথা নিচু করে কাজ। ভৌমিকের চোরা চাহনি। তার এখন একটু বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে।
”এখন কি তাকে পাবেন?”
”দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত থাকে। যাব আর আসব, কেউ খোঁজ করলে বলে দিয়ো নীলরতনে গেছি একটু দরকারে।”
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দোতলায় ডিরেক্টরের ঘরের দরজায় পাপোশটার দিকে প্রিয়ব্রত তাকাল। মাঝখানটা ক্ষয়ে গিয়ে মসৃণ। কত বছর বয়স হল পাপোশটার! দেয়ালে চার দফা দাবির পোস্টার। তার নীচে পুরনো একটা মিটিংয়ের পোস্টার। তারও নীচে আর একটার ছেঁড়া কোণ দেখা যাচ্ছে। পরতে পরতে দাবির, মিটিংয়ের এই খোলসটা কত যত্নে লড়াই করে এরা বাঁচিয়ে চলেছে। যেদিন ওটা ভেঙে যাবে…! সুখেন্দু বেঞ্চে পা তুলে বসে। তাকে দেখে পা নামাল। প্রিয়ব্রত না দেখার ভান করল।