”আমার আর এখানে থাকার কোনো দরকার নেই…থাকার মানে হয় না।” ধীর পায়ে সে থানা থেকে বেরিয়ে এল।
বাড়ি ফিরে প্রিয়ব্রত প্রতিদিনের মতো মাথা না ভিজিয়ে স্নান করল। ওমলেট আর চা খেয়ে, টিভি দেখার জন্য খাটে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে দিল। চর্মরোগ সম্পর্কে দুজন ডাক্তারের মতামত মন দিয়ে শুনল। ভরতনাট্যম নাচ দেখল। পেঙ্গুইনদের নিয়ে তথ্যচিত্র তার ভালো লাগল। বাংলা গোয়েন্দা সিরিয়ালের পর সে তিলুর সঙ্গে মন্তব্য বিনিময় করল। হিন্দি খবর শুরু হতেই রোজকারমতো টিভি বন্ধ করে তিলু খবরের কাগজগুলো তাকে এনে দিল। প্রিয়ব্রত খুঁটিয়ে পড়া শুরু করল।
পড়ার মাঝে একবার সে ভ্রু কুঁচকে জানলার দিকে আনমনা দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর সে আবার কাগজ পড়তে শুরু করে। কিন্তু কী যে পড়ছে তা সে জানে না। তবে নিজেকে সে বহুদিন পর শান্ত বোধ করছে। এতকাল ধরে সে কিছু একটা চাইছিল, সেটা যেন এবার খুঁজে পেয়েছে। কোনোরকম ভাবনার মধ্যে নিজেকে আর জড়িয়ে ফেলতে রাজি নয়। সে জেনে গেছে, তার ভণ্ডামি ধরে ফেলার লোক আছে।
পরদিন প্রিয়ব্রত অফিসে পৌঁছল পঁচিশ মিনিট আগে। তাদের ঘরের একজনও তখন আসেনি। শূন্য, নিস্তব্ধ ঘরটা তাকে অবাক করল। অস্বাচ্ছন্দ্যে ফেলল। ছাব্বিশ বছরে এই প্রথম তার অফিসকে প্রাচীনযুগের সংগ্রহে ভরা একটা ঘরের মতো লাগছে। ডা. গুপ্তার কথা তার একবার মনে পড়ল। পঁচিশ বছর ধরে লোককে ঠকিয়ে গেছেন আজেবাজে ফসিলের উপর গবেষণা-প্রবন্ধ লিখে। অধ্যাপক নাকি মামলা করবে!
প্রিয়ব্রত চেয়ারে চুপ করে বসে, আধা আঁধারি অফিস ঘরের মেঝে, দেওয়াল, পার্টিশান, আলমারি, চেয়ার-টেবিল, র্যাকের ধুলোজমা থরে থরে রাখা ফাইলগুলোর উপর চোখ বোলাল। এগুলোও তো ফসিল! কত লোকের জীবনের সেরা সময়গুলো এরমধ্যে পরতে পরতে জমে ছাপ ফেলে রেখেছে। কেউ এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করবে না।
”অতুলদা, আজ যে এত শিগ্গিরি!”
ভৌমিক। আরও একটা ফসিল। না, এখনও হয়নি তবে হতে যাচ্ছে। মেয়ের বাবা হয়ে সুখী, প্রাইস ইনডেক্স চড়লে গলা চড়ায় আর বিক্ষোভ জানায়, সংসারে অন্ন জোগাবার সংখ্যা যাদের কম তাদের হিংসে করে।
”এই এসেছিলাম এদিকে একটা কাজে।” প্রিয়ব্রত ড্রয়ার বন্ধ করল। সব চেয়ারেই লোক এসে গেছে। ”নীলরতনে এক ডাক্তারের কাছে গেছলুম।”
”নিজের জন্য? কী হয়েছে?” ভৌমিককে সন্ত্রস্ত দেখাল। ওর আঠাশ বছরের ওয়েটলিফটার ভাই ক্যানসারে মারা গেছে। ডাক্তার, হাসপাতাল শুনলেই কমজোরি হয়ে পড়ে।
”ব্লাড সুগার টেস্ট করাতে বলেছিল। টেস্টের রিপোর্টটা নিয়ে গেছলাম দেখাবার জন্য।”
”কী বললেন ডাক্তার?”
”ঘরে ছিল না, ওয়ার্ডে বেরিয়েছে। ওর টেবিলে রেখে দিয়ে সে চিঠি লিখে।…দুশো চব্বিশ পি পি। বেশি নয়, কি বলো?”
”কে বললে বেশি নয়? দুশো চব্বিশটা চারশো চব্বিশ হতে ক’দিন? খুব পাজি রোগ এই ডায়বেটিস। এর থেকে কত রকমের যে রোগ হতে পারে, অতুলদা আপনি জানেন না।”
কে বলল জানি না। প্রিয়ব্রত মুখে হাসি টেনে রেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। ভৌমিকের দিকে। অতুল ঘোষ নামের এই লোকটাই তো একটা রোগ। চব্বিশ বছর ধরে মিথ্যের মধ্যে ডুবে থেকে মিথ্যা কথা বলাটা কেমন জল-ভাত করে ফেলেছে। অম্লান বদনে বলে ফেলল ডাক্তারের কাছে গেছলাম, ব্লাড সুগার টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে।
”হার্ট ডিজিজ হতে পারে, হ্যাঁ।” ভৌমিক চাপা স্বরে খবরটা জানাল।
”আমিও তাই শুনেছি।”
”আমার মামাশ্বশুর মারা গেছেন হার্টের রোগে। ডায়বিটিস ছিল। আপনি খাওয়া-দাওয়ায় সাবধান হোন, চিনি একদম নয়। এখানে চায়ে বড্ড চিনি দেয়, খাওয়া বন্ধ করুন। মাটির নীচে জন্মায় যেসব আনাজ, আলুটালু…।”
”খাই না। শাঁকালু, মুলো, পেঁয়াজ…।”
”জোরে জোরে রোজ মাইলখানেক হাঁটুন।”
”ভাবছি হেঁটেই বাড়ি ফিরব।”
”সকালে করলার রস যদি…”
”আধ কাপ করে খাই।”
”এ রোগ তো কখনো সারে না, তবে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করলে কন্ট্রোলে রাখা যায়।”
স্বদেশ আসছে। প্রিয়ব্রত তিন-চারটে ফাইল গোছা করে সামনে রেখে ফিতে খুলতে শুরু করল। ভৌমিকের মুখোমুখি স্বদেশ বসল। ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে ভৌমিক কথা বলছে।
”সে কি…কই দেখে তো মনে হয় না!”
স্বদেশ যত রাজ্যের হাঁড়ির খবর, গোপন ব্যাপার নাকি জানতে পারে অথচ এই খবরটারই হদিশ পায়নি। প্রিয়ব্রত মনে মনে হাসল। ‘ডেঞ্জারাস লোক এই স্বদেশ সরকার।’ সত্যিই কি খুব বিপজ্জনক? ‘পৃথিবীতে কোন লোকের না গোপন ব্যাপার আছে বলুন? আমার আছে, আপনার আছে, অতুলদার’…।
”সেকসুয়াল পাওয়ার কমে যায়। হ্যাঁ, সত্যি। ডায়বিটিস বড়ো বাজে জিনিস…অবশ্য ওনার তো এ ব্যাপারে তেমন সমস্যাই নেই।”
”কেন থাকবে না? বউ না থাকা মানেই কি সেকস না থাকা? এই বয়সটাই তো, মানে যৌবন চলে যাওয়ার সময়টাই তো…।”
প্রিয়ব্রতর কপালের দু’ধার দপদপ করে উঠল। স্বদেশ কি এখন একটা ডেঞ্জারাস জায়গায় চলে যাচ্ছে? এইরকম জায়গায় হিতুও পৌঁছে গেছল। ‘নিঃসঙ্গ বোধ করছ…কম্প্যানিয়ন চাই?’…’মা মারা যাবার পর তুমি তো বিয়ে করতে পারতে!’
হিতু হঠাৎ এ কথা বলল কেন?
বাবা কেন নিরুকে লোডশেডিংয়ের মধ্যে বাড়িতে নিয়ে এল? হিতুর মাথার মধ্যে এটাই প্রথমে গেঁথে গেছল। কিন্তু গাঁথল কেন? মাথাটা নিশ্চয় নরম হয়েছিল অনেকদিন ধরেই তাই ব্যাপারটা চট করে বসে যেতে পেরেছে। ও কি তাকে লক্ষ করত? কবে থেকে….কৈশোরে পৌঁছবার সময় থেকেই কি বাবার সম্পর্কে এই ধরনের ভাবনা এসেছিল?