”…তা পুলিশ কী করবে? কর্পোরেশন যদি আবর্জনা রাখার জায়গা আপনাদের বাড়ির সামনে করে তাহলে কর্পোরেশনকে গিয়েই বলুন, এখানে এসেছেন কেন?”
”তাহলে স্যার ওই জঞ্জাল দিয়ে যখন রাস্তা বন্ধ করব তখন কিন্তু পুলিশ-টুলিশ মানব না। এটাই আগাম জানিয়ে গেলাম।”
”সে তখন দেখা যাবে।”
”হ্যাঁ, তখন দেখবেন…চল চল।”
ওরা টেবলের সামনে থেকে সরে যেতেই প্রিয়ব্রত বড়োবাবুর মুখ দেখতে পেল। গৌরবর্ণ, চৌকোমুখ। পাশে সিঁথিকাটা চুল। গলা, বুক ও কাঁধের গড়ন জানান দিচ্ছে ব্যায়াম করেন। চোখ দুটি টানা এবং ছোটো। দুটি মণি প্রায় দেখাই যাচ্ছে না।
”আমার নাম প্রিয়ব্রত নাগ। আমাকে…”
”ওহ বসুন বসুন। আপনার ছেলের সঙ্গে ফোনে পরশু কথা বলছিলাম…আপনিও বসুন।”
খুদিকেলো তার পাশের চেয়ারটায় বসল। বড়োবাবু দরজার দিকে তাকিয়ে কাকে যেন বললেন, ”নিয়ে এসো।” তারপর ওদের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে, ”পাওয়া গেছে। বউবাজারেই আজ ধরা পড়েছে।…আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে-”
”কে ধরা পড়েছে?” প্রিয়ব্রত শ্বাসবন্ধ রেখে কথাটা বলে ঝুঁকে পড়ল।
”ওনার মেয়ে, নিরুপমা…এই যে।”
একই সঙ্গে প্রিয়ব্রত আর খুদিকেলো মুখ ঘোরাল। নিরুর পরনে একটা ছাপা খয়েরি রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ, অবিন্যস্ত চুল, আঁচলে ঘাড়, গলা ঢেকে রাখা। পায়ে হাওয়াই চটি। সে সোজা হয়ে বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল। বসার চেয়ার আর নেই। ঘরে দেওয়ালের ধারে বেঞ্চটা দেখিয়ে বড়োবাবু ইশারা করলেন ওখানে বসার জন্য। নিরু ধীরগতিতে গিয়ে বসল। এমনভাবে দুটি হাত আড়াআড়ি বুকের ওপর রাখল যেন উপেক্ষা ছাড়া ঘরের লোকগুলোকে আর তার কিছু জানাবার নেই। চোখে ঝাঁঝালো প্রতিরোধ তৈরি হয়ে উঠেছে।
”ধরেই নিয়েছিলাম, যদি কোথাও যায় তো ওই কালপ্রিটদের কাছেই আগে যাবে।…ভয়টা তো ওদেরই…মেয়েছেলে, দুর্বল ভিতু, প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ওদের কাছে গিয়েই তো নিজেকে সাবমিট করবে। খুব কমন সায়কোলজি।” বড়োবাবু হাসলেন। চোখদুটো তাতে প্রায় বুজে গেল। ”নজর রাখা ছিল। ওদের মধ্যে বাচ্চচা নামে একটা ছেলে, ওই কার্ডবোর্ড কারখানাতেই কাজ করে, তার মা’র সঙ্গে যখন নিরুপমা একটা নার্সিংহোম থেকে বেরোচ্ছে তখনই পুলিশের হাতে পড়ে। নাবালিকা নয়, স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে গেছে, এক্ষেত্রে আমাদের তো কিছু করার নেই।”
বড়োবাবু যখন কথা বলছেন, প্রিয়ব্রত আড়ষ্ট হয়ে একদৃষ্টে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। একবারের জন্যও সে মুখ পাশে ফেরায়নি। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল নিরু তাকে লক্ষ করছে।
”স্যার আপনি সন্দেহ করেছিলেন আমিই ওকে কোথাও পাচার করেছি।” খুদিকেলো অনুযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের দিকে তাকাল।
”সন্দেহ হয়েছিল যেহেতু আপনি এই ভদ্রলোকের চরিত্রে কলঙ্ক লেপে দিতে চেয়েছিলেন। আর সেইজন্যই ওনাকে ডেকে এনেছি, মেয়ের সামনে আপনি বলুন কেন ওনার চরিত্র হনন করার মতো অপবাদ দিয়েছিলেন? উনি তো এখন মানহানির মামলা করতে পারেন।”
”বিশ্বাস করুন স্যার, প্রিয় আমার ছোটোবেলার বন্ধু, ওর সম্পর্কে কখনোই আমার খারাপ ধারণা ছিল না, আজও নেই। শুধু ওই হারামজাদি মেয়েই আমার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কি বলে ছিল জানেন!” খুদিকেলো মুখ ঘুরিয়ে নিরুর দিকে তাকাল, বড়োবাবুও তাকালেন। প্রিয়ব্রত সোজা সামনে তাকিয়ে রইল।
ঘরটা হঠাৎ নৈঃশব্দ্যে ভরে গেল।
”বলেছিল, তোমার ওই বন্ধুটা খুব বিপজ্জনক লোক। আমাকে নিয়ে পালাতে চাইছে।”
”না। মিথ্যেকথা, একদম মিথ্যে।” প্রিয়ব্রত উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল। বড়োবাবু হাত তুলে শান্ত থাকতে ইশারা করলেন।
”তুমি বাবাকে একথা বলেছ?”
”হ্যাঁ।”
”উনি কি তোমাকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন?” গম্ভীর, শান্ত এবং অনিশ্চিত বড়োবাবুর স্বর।
ঘরে আবার স্তব্ধতা ফিরে এল। প্রিয়ব্রত মুখ নামিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটা মিথ্যাকথাই বলছে না, আসলে তাকে খুন করছে।
”জবাব দিচ্ছ না কেন?”
”না, উনি আমাকে নিয়ে পালাবার কথা বলেননি।”
”তাহলে? তুমি বাবাকে তাহলে বললে কেন-?”
”আমার মনে হয়েছিল।” ঠান্ডা পরিষ্কার স্বরে নিরু ঘরটাকে অপ্রতিভ, বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল।
”মনে হয়েছিল মানে? উনি মুখে তাহলে কিছু বলেননি?”
”আমার মনে হয়েছিল উনি পালাতে চান। কিন্তু একা পালাবার সাহস নেই, তাই আমাকে সঙ্গে চান। কেন যে মনে হয়েছিল বলতে পারব না।…লোডশেডিং হয়েছিল, অন্ধকার রাস্তায় কয়েকটা লোক এগিয়ে আসছিল। আমি ভয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি, উনিও আমাকে জড়িয়ে ধরেন…না না, খারাপ উদ্দেশ্য ওনার ছিল না। কিন্তু আমার তখন মনে হল, কেন যে মনে হল জানি না,….বোধহয় ওর কাছে আশ্রয় চাওয়া যায়। আমি চেয়েছিলাম…বারবার বলেছিলাম থাকতে দিন আপনার নীচের ঘরে, মামলা কেঁচে না যাওয়া পর্যন্ত থাকতে দিন। উনি দেননি।”
নিরুর গলা কাঁপছে। স্বর বুজে এল ক্ষোভ, লজ্জা আর দুঃখের চাপে। দুচোখে জলে ভরে উঠেছে। মুখটা নামিয়েই আবার ঝাঁকুনি দিয়ে তুলে সে কঠিন গলায় বলল, ”…উনি ভিতু, উনি কাপুরুষ, উনি…।”
চেয়ারটা পিছনে ঠেলে দিয়ে প্রিয়ব্রত উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে নিজের চেয়ারেই প্রায় হোঁচট খেল। হুমড়ি থেকে সামলে ওঠার সময়, মুহূর্তের জন্য নিরুর সঙ্গে তার চোখাচোখি হল, তার মনে হল একশো রকমের কথা ওর চোখে ফুটে রয়েছে কিন্তু একটারও অর্থ তার বোধগম্য হচ্ছে না।