”কি অতুলবাবু, চললেন নাকি?”
”হ্যাঁ ভাই।”
”উনি এসব দাবিওয়ার ব্যাপারে থাকেন না।”
থাকি না কেন? কোনো দাবিই কি আমার নেই? প্রিয়ব্রত একবার আকাশে তাকাল। মেঘ নেই। কালবৈশাখী আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বৃষ্টি পড়বে না, কোনো দোকানের দরজায় উঠে দাঁড়াতে হবে না। হঠাৎ দেখা হওয়া ছোটোবেলার কোনো বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে আলাপের সম্ভাবনা দেখলেই সে এড়িয়ে যাবে।
কোনো দাবিদাওয়াই কি নেই? হিতু হলে কি বলত? বাবা জীবনটাকে চুমুক দিয়ে খাওয়ার দাবি জানায়নি বলে ছেলে তাকে মানুষ হিসেবে তুচ্ছ মনে করে! যারা গেটে স্লোগান দিচ্ছে তারাও হয়তো তাকে মেরুদণ্ডহীন, সুবিধাভোগী ভাবে,…এমনকি নিরুও হয়তো! সেদিন ওর চোখে এই কথাটাই বোধহয় ছিল-এইজন্যই আমি খুন হব।
যদি সে নিরুকে বলতে পারত, আমার একতলার ঘরেই লুকিয়ে থাক ক’টা দিন! মামলাটা কেঁচে না যাওয়া পর্যন্ত গুন্ডাদের হাত থেকে আমি তোমাকে লুকিয়ে রাখব। তাহলে ওর চোখে কি ভাষা ফুটে উঠত?
খুদিকেলো তারপরও কি থানায় গিয়ে বলত, এই লোকটার বউ মরে গেছে, তাই আমার রেপড হওয়া মেয়েকে ফুসলিয়ে বাড়িতে নিয়ে তুলেছে?….থানার ওসি ঠিকই বুঝছে, ‘লোকটা যেমন ধূর্ত তেমনি ভীতু।’ হতে পারে, খুদিকেলো নিজেই নিরুকে কোথাও সরিয়ে দিয়েছে। মেয়ে বেঁচে থাকলে কাজকর্ম করে কিছু টাকা সংসারে এনে দিতে পারবে। নিরুকে ও বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
কিন্তু তাই বলে এতবড়ো একটা অপবাদ তার নামে কেন দেবে? ভৌমিকের মতো খুদিকেলোও ‘দুটো তো মাত্র লোক…কোনো সমস্যাই নেই’ ভেবে নিয়ে ঈর্ষার জ্বালায় কি এই ধূর্তোমিটা করল? অভাব আর পাঁচটা মেয়ে নিয়ে খুদিকেলো ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারে, কিন্তু সেজন্য এতটা নীচে নামবে?
সেন্ট্রাল অ্যাভিনু পার হয়ে প্রিয়ব্রত গুপী বসাক লেনে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটা জিপ দাঁড়িয়ে। পুলিশের জিপ! দিন দশেক আগে দু’দলের বোমার লড়াই হয়েছিল সকালে। অফিস যাবার সময় ওখানেই একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। ধুতি-হাফ শার্ট পরা। কাঁচাপাকা চুল, গোল মুখ, লম্বা চওড়া এক জমাদার হাতে লাঠি নিয়ে মিষ্টির দোকানির সঙ্গে কথা বলছিল, আর জিপের ধারে ইউনিফর্ম পরা এক এস আই দাঁড়িয়েছিল। জিপের পিছনে রাইফেল নিয়ে বসেছিল একজন। আবার কি বোমাবাজি হয়েছে! কৌতূহলী হয়ে প্রিয়ব্রত এগোল।
রাস্তাটা চওড়া থেকে সরু হয়েছে যেখানে, জিপটা সেখানেই দাঁড়িয়ে। তিনটি ছেলে একটু দূরে শিথিল ভঙ্গিতে ডাক্তারবাবুর সিঁড়ির ধাপে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ওদের প্রায় সবসময়ই এখানে বসে থাকতে দেখা যায়। বাচ্চচারা রাবারের বল খেলছে রাস্তায়। আলুকাবলিওলাও রয়েছে। বাড়ির দেয়াল ঘেঁসে বসা মুচি জুতো সারাইয়ে ব্যস্ত। কয়লার দোকানের সামনে গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে। প্রিয়ব্রতর বুকের মধ্যে দপদপানি শুরু হল। সবই প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক তাহলে পুলিশের জিপ কেন?
”এই যে, এই যে…” সিঁড়িতে একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জিপের দিকে হাত নাড়ল। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে কাঁচাপাকা চুলের একটা গোলাকার ভরাট মুখ উঁকি দিল। প্রিয়ব্রত চিনল। লাঠি হাতে সেদিনের সেই জমাদার। ”কাকাবাবু পুলিশ আপনাকে খুঁজছে।”
কথাটা কানে লাগল প্রিয়ব্রতর। আপনা থেকেই সামনের বারান্দা আর জানলায় তার দৃষ্টি চলে গেল। নীরোদ কাকা দাঁড়িয়ে, পাশে ওর বউ। পাড়ার সার্বজনীন দুর্গাপুজোয় উনি বহু বছর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। একতলার জানলায়, চুলবাঁধায় ব্যস্ত একটি বউ উঁকি দিল।
প্রিয়ব্রত জিজ্ঞাসু চোখে জিপের দিকে তাকাল। জমাদারটি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
”আপনিই প্রিয়ব্রত নাগ? পঁচিশ নম্বর গুপী বসাক লেনে থাকেন?” কথায় হিন্দি টান কিন্তু পরিষ্কার বাংলায় জমাদার যথাসাধ্য বিনীত হবার চেষ্টা করল।
”হ্যাঁ, আমিই।”
”বড়োবাবু আপনাকে থানায় নিয়ে যাবার জন্য পাঠিয়েছেন, জরুরি দরকার। আপনার বাড়ি ঘুরে এসে এখানে দশ মিনিট হল অপেক্ষা করছি, পেছনে উঠে পড়ুন।”
…অফিস কি এত তাড়াতাড়ি অ্যাকশন নেবে? একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তো যেতে হবে, সেজন্য সময়ও লাগবে! কী ব্যাপার? প্রিয়ব্রতর বুকের মধ্যে বরফ তৈরি হচ্ছে। গৌরাঙ্গ তাহলে কি আর অপেক্ষা করেনি?
”গেলেই জানতে পারবেন।”
জিপের পিছনে গিয়ে প্রিয়ব্রত ভিতরে তাকিয়েই নিথর হয়ে গেল। খুদিকেলো বসে রয়েছে। তাকে দেখে জায়গা করে দিতে সে সরে বসল।
মিনিট তিনেক লাগল থানায় পৌঁছতে। তারমধ্যে একটা কথাও বিনিময় হয়নি ওদের মধ্যে। প্রিয়ব্রত সারাক্ষণ মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। নিজেকে চিন্তার মধ্যে ঠেলে দেবার সাহস তার আর ছিল না। খুদিকেলো মাথা নামিয়ে বিরক্ত স্বরে দু-তিনবার বিড়বিড় করেছে। সে জানে কেন তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
”ঘরের মধ্যে যান।” দরজায় দাঁড়ানো সান্ত্রী চোখের ইশারায় ঘরে ঢুকতে বলল। থানায় এই প্রথম তার আসা। প্রিয়ব্রত দ্বিধা করছিল। খুদিকেলো ঢুকে গেল তাকে পাশ কাটিয়ে।
টেবিলটা আকারে তার ডিরেক্টরের ঘরের টেবিলের মতোই। তবে টেবিলের উপর কাচটা নেই, কাগজ বা ফাইলেরও ছড়াছড়ি নেই। একটা ফুলদানি, তাতে মরশুমি ফুলও রয়েছে, প্লাস্টিকের নয়। টেবিলের সামনে তিনটি লোক দাঁড়িয়ে, তাদের একজন লুঙ্গি পরা, ঘরে ঢুকেই প্রিয়ব্রত যার ধমক শুনতে পেল, অনুমান করল সেটা বড়োবাবুই।