প্রিয়ব্রত স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আবার একটা ভয় তাকে গিলতে আসছে।
৬
ঘড়ির দিকে সে তাকাল। ভৌমিকের চেয়ারটা খালি। এইমাত্র নেমে গেল দোতলায়। চারদফা দাবি আর দুজন ব্লক সার্ভেয়ারের সাসপেনসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানানো হবে অফিসের গেটে। এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সক্রিয় সদস্য ভৌমিক সেজন্য ব্যস্ত। প্রিয়ব্রতও সদস্য কিন্তু সে বিক্ষোভ, অবস্থান বা মিছিলে থাকে না। এজন্য ভৌমিক এবং আরও অনেকের টিপ্পুনি সে শুনেছে। তর্কাতর্কির মধ্যে না গিয়ে সে শুধু হেসে মাথা নাড়ে।
‘আমার থাকা আর না থাকা একই কথা। সত্যিকথা বলতে কী ভৌমিক, চিৎকার, চেঁচামিচি, ঘুষি পাকানো আর গালাগাল আমার ভালো লাগে না। পঁচিশ বছর ধরে যা দেখে আসছি আজও তাই চলছে, কিছুই বদলাল না।’
‘ঠিকই বলেছেন অতুলদা,’ কিছু বদলায়নি শুধু ধাপে ধাপে চড়ছে প্রাইস ইনডেক্স। ওটার সঙ্গে পাল্লা দিতেই আমরা গলা চড়াচ্ছি। আপনার আর কি দুটো মাত্র লোক! ছেলেও চাকরি করছে, কোনো সমস্যাই নেই।’
ভৌমিক তার সমস্যার কতটুকু জানে? ও কি প্রিয়ব্রত নাগকে জানে? কাল কি গৌরাঙ্গকে সিঁড়িতে ধরার জন্যই স্বদেশকে নিয়ে উঠে গেল? ফণী পাল, খুদিকেলো, গৌরাঙ্গ, হিতু, নিরুকে কি জানে? ওর কাছে সমস্যা বলতে শুধু সংসারে অন্ন জোগাবার মানুষের সংখ্যা নিয়ে। ‘জানলেন অতুলদা, আমার খুব মেয়ের শখ তাই বউকে বলেছিলুম সেকেন্ড ইস্যু যদি মেয়ে হয় তাহলে অপারেশন করে নোব। কি লাক দেখুন ঠিক মেয়েই হল।’
আবার সে ঘড়ির দিকে তাকাল, ঠিক এই সময়টাতেই ফণী পাল আসত, গৌরাঙ্গও কাল এসেছে। বোধহয় এটাও ফণী পাল ছেলেকে বলে দিয়ে গেছে, কখন যেতে হবে। আজ হয়তো আসতে পারে। আজ না কাল না পরশু কবে যেন আসবে বলে গেছিল। সে আর একবার মনে করার চেষ্টা করল। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে লোকটা বলে গেল অথচ মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তিটা কমে আসছে।
”অতুলদা এখনও বসে যে? যাবেন না?”
স্বদেশ। ওর চিঠিটা হিতুকে দেওয়া হয়নি। বোধহয় চিঠির কথাই জানতে এসেছে।
”কোথায়? গেটে? না, জানোই তো আমি কখনো এসবে থাকি না।”
”থাকাটা দরকার।” স্বদেশ টেবিলের উপর ঝুঁকে হঠাৎ গলার স্বর নামাল। ”অফিসে কখন যে কীসে ফেঁসে যাবেন আপনি তা জানেন না।…একটা মেমো যদি ধরিয়ে দেয়, তখন আপনি একা লড়ে সেটা উইথড্র করাতে পারবেন? বলুন, পারবেন? যে দুজন সাসপেন্ড হয়েছে, জানি তাদের দোষ আছে, কিন্তু আমরা অর্ডার উইথড্র করাবই…ওরা আমাদের অ্যাকটিভ মেম্বার।”
‘ফেঁসে যাবেন’ বলল কেন? প্রিয়ব্রতর ভ্রু আপনা থেকেই কুঁচকে উঠল। তাহলে গৌরাঙ্গর সঙ্গে ওরা দুজন কি কাল কথা বলেছে? কিন্তু লোকটাকে তো ধূর্ত বলেই মনে হল। হাতের তাস দেখাবার মতো বোকা নয়।
”তোমার চিঠিটা ছেলেকে দিয়েছি। ”কাল অফিসে বসেই লিখে, টাইপ করিয়ে নিলুম। একটু ভেবেচিন্তে লিখলে-”
”না না, বেশি ভাবলে লেখা আড়ষ্ট হয়ে যায়। দ্যাখোনা, যেসব মানুষ খুব ভাবে তারা নিজেদের এক্সপ্রেস করতে পারে না।”
”যেমন আপনি। আপনাকে প্রথম থেকেই দেখছি, কী যেন একটা চিন্তায় ডুবে আছেন, কম কথা বলেন। দেখলেই মনে হয় ভীষণ জটিল একটা দার্শনিক সমস্যা নিয়ে অবিরত ভেবে চলেছেন!”
”আমাকে দার্শনিক দেখায় নাকি? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে তো!”
”বুঝতে পারবেন না। নিজেকে নিজে খুব শক্ত। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আপনি সচেতন হয়ে পড়বেন আর তখন অন্য একটা লোককে দেখবেন।…আসলে অতুলদা, একটা মানুষের মধ্যে সব সময় দুটো লোক থাকে, ডাক্তার জেকিল আর মিস্টার হাইড। এইজন্যই আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল পর্যন্ত আঁচড়াই না। কি জানি বাবা, নিজের কি চেহারা দেখে ফেলব?”
স্বদেশ পকেট থেকে চিরুনি বার করে চোখের সামনে তুলে, ময়লা রয়েছে কি না দেখতে লাগল। প্রিয়ব্রত পাংশু মুখে তাকিয়ে। জেকিল আর হাইড মানে প্রিয়ব্রত আর অতুল, এটাই তো বলতে চায়! তাহলে এরা জেনে ফেলেছে।
দরজার কাছ থেকে একজন ”স্বদেশ” বলে চেঁচিয়ে উঠল। তারদিকে হাত তুলল স্বদেশ অপেক্ষার ইঙ্গিত জানিয়ে।
”চলি অতুলদা…যা বললুম, আন্দোলনে বিক্ষোভে থাকার চেষ্টা করুন। চিঠিটা কি তাড়াতাড়ি বের করা সম্ভব? মশার উৎপাত থাকতে থাকতে বেরোলেই ভালো হয়। যাই হোক দাদা, আমার হয়ে ছেলেকে তাগাদা দেওয়ার ভারটা আপনার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি।” কথা বলতে বলতেই চিরুনিটা চুলে বসিয়ে স্বদেশ দরজার দিকে এগোল। প্রিয়ব্রত ওর চুল আঁচড়ানো দেখতে লাগল। ওর নাকি আয়নার দরকার হয় না!
আন্দোলনে বিক্ষোভে থাকতে হবে! দল বেঁধে চিৎকার করলে গৌরাঙ্গ কি উইথড্র করবে কিংবা খুদিকেলো? আমিও তো এই পৃথিবীতে, সংসারের একজন অ্যাকটিভ মেম্বারই।…যেদিন ফণী পালকে পাঁচ হাজার টাকা দিলাম সেদিন আমি নিজেই তো মেমো দিয়েছি নিজেকে!-‘জানি তাদের দোষ আছে কিন্তু আমরা অর্ডার…’ আমরা? কিন্তু আমি তো একা!
প্রিয়ব্রত ঘড়ি দেখল, গৌরাঙ্গ আজ আর তাহলে আসছে না। ড্রয়ার বন্ধ করার জন্য সে মুখ ফিরিয়ে নীচে তাকাল। সাদা খামটা ওপরেই রয়েছে। ড্রয়ার ঠেলে চাবি ঘোরাল। গেটের কাছে নিশ্চয় এতক্ষণে ভিড় জমে গেছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ই স্লোগান শুনতে পেল। গেটের দিকে এগোবার সময় আপনা থেকেই তার মাথাটা ঝুঁকে পড়ল। সিমেন্ট বাঁধানো পথের দিকে তাকিয়ে চলতে চলতে সে একটা লিচুর বিচি দেখে থমকে দাঁড়াল। এর উপর জুতো পড়লে হড়কে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বিচিটাকে পা দিয়ে পাশে সরিয়ে দেবার সময় তার ফণী পালকে মনে পড়ল। লাঠিটা দিয়ে নিশ্চয় সে এই কাজই করত। লোকটা ক্যানসারের যন্ত্রণা পেয়েছে অথচ কাউকে তাই নিয়ে বিব্রত করেনি। কিছু গুণ অবশ্যই ছিল।