প্রিয়ব্রত উঠে দাঁড়াল। হিতু কাগজ নামিয়ে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই সে বলল, ”আমাকে ব্ল্যাকমেল করা যাবে না। অনেক সয়েছি অনেক…আর আমি নুইব না।”
একটা অন্ধকার হঠাৎ ঝলসে উঠল তার চোখের সামনে। মাথাটা টলে গেল। চোখ বন্ধ করে দুহাত সামনে বাড়িয়ে দুলতে দুলতে, টেবিলের উপর ঝুঁকে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টায় সে নখ দিয়ে সানমাইকা আঁচড়াতে লাগল। হিতু তার মুখ লক্ষ করছিল। কপালে বিনবিনে ঘাম, মুখ ছাই রঙা, চোখ দুটো বসা। চমকে উঠে সে প্রিয়ব্রতর হাত ধরল।
”বোসো। বোসো বলছি।” নরম গলায় ধমক দিল হিতু। ”খাটে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো গিয়ে, মনে হচ্ছে প্রেশার উঠেছে, একবার ডাক্তার দেখানো দরকার। ঘরে চলো।”
”কিছু হয়নি আমার…হাত ছাড়।”
প্রিয়ব্রত চেয়ারে বসে মুখ ফিরিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কপালে ভাঁজ পড়ল হিতুর। কাগজটা তুলে আবার সে টেবিলে ফেলে দিল।
”তিলু, ভালো করে একটু চা কর। বাবা খাবে।”
”না।”
”যা বললাম তাই করো, একটু শুয়ে থাকো। তোমার একটা চেকআপ করানো দরকার।”
”দরকার নেই, ঠিক আছি। তিলু, থলিটা দে।”
”যেতে হবে না বাজার।”
”কেন, কী এমন হল যে বাজার যাওয়া যাবে না?”
প্রিয়ব্রত উঠে ঘরে চলে গেল। লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল হিতু থলি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে।
”আজ আমি বাজার যাব।”
প্রিয়ব্রত বারণ করল না, নিজে বাজার যাবে বলে জেদাজেদিতেও গেল না। নিজের ঘরে ফিরে এসে করার মতো কিছু একটা খুঁজতে লাগল। ব্যস্ত থাকতে হবে, নয়তো তার অস্থিরতাকে বাগ মানাতে পারবে না। খাটের নীচে ফুলঝাড়ুটা দেখে উবু হয়ে সেটা তুলে নিয়ে সে ঝাঁট দিতে শুরু করল।
খুদিকেলোর সঙ্গে দেখা করে একটা বোঝাপড়া দরকার। তার সম্পর্কে বিশ্রী একটা সন্দেহের কথা পুলিশকে সে কেন বলল, এটা জানতে হবে। হিতু বিশ্বাস করেনি, ও সি বিশ্বাস করেনি, কিন্তু বহুলোক আছে যারা বিশ্বাস করবে। জ্যাঠামশাইদের বাড়ির সবাই, ভৌমিক, স্বদেশ…মঙ্গলা বেঁচে থাকলে এই ধরনের কথা উঠতই না।
প্রিয়ব্রত ছবিটার দিকে তাকাল। বিয়ের দিন পনেরো পর ছবির দোকানে গিয়ে তোলা। সে চেয়ারে বসে, পাশে দাঁড়িয়ে মঙ্গলা। ওর একটা হাত ছিল তার কাঁধে। হাতে ছিল মোটা বালা আর কয়েকগাছা চুড়ি। আঙুলে আংটি। ওই ছবিটা থেকেই মুখটা আলাদা বার করে বড়ো করিয়ে নেওয়া। সিঁথেয় সিঁদুর আর কপালের টিপটা রঙ করানো।
ফোটোগ্রাফার বলেছিল, এইদিকে তাকান, হাসুন…হাসুন। দুটো জোরালো আলো জ্বলছিল। একটা পাশ থেকে একটা সামনে নিচু থেকে। আলোর তাতে মঙ্গলার মুখে ঘাম ফুটেছিল। তারা দুজনেই তখন হেসেছিল, জোর করেই হাসা। কিন্তু এখন মঙ্গলার মুখে সেটা মিষ্টি দেখাচ্ছে। ওর মুখের নীচের দিকটা হিতু পেয়েছে, কিন্তু আর কিছু কি?
রাতে তৈরি রুটি সে সকালে খেত, হিতুর জন্য পাঁউরুটি। ভোরবেলায় দুধ আনার সময় কিনে আনত। সে নিজের হাতে সেঁকে জেলি মাখিয়ে দিত। হিতু বছরখানেক পর জানতে পারল তার বাবা রাতের বাসি রুটি খায় গুড় দিয়ে। জেনে ও খুব অবাক হয়ে গেছিল এইজন্যই যে, বাবা কীভাবে এটা তার কাছে লুকোতে পেরেছে এতদিন!
‘খুবই সহজ, তুই যদি আমার আগে ঘুম থেকে উঠতিস তাহলেই দেখে ফেলতিস।’ পরের দিনই ঘুম ভেঙে সে হিতুকে পাশে দেখতে পায়নি। ঘর থেকে বেরিয়েই দেখে টেবিলে বসে হিতু রুটি চিবোচ্ছে।
”এবার থেকে আমি রুটিই খাব।”
তখন ওর বয়স বারো। হাজার অনুরোধেও ওইটুকু ছেলেকে সে জেদ থেকে টলাতে পারেনি। এতে কী গভীর সুখ যে সে পেয়েছিল! মঙ্গলাও সুখী হত। বেঁচে থাকলে দেখে যেতে পারত, দিনে দিনে তারপর সেই হিতু বড়ো হল। টিভি আনল, ফ্রিজ আনল, মোটরবাইক চড়ছে। বিদ্যেবুদ্ধি বেড়েছে।…কিন্তু ফণী পালের কথা কখনো জানতে পারেনি। এই একটা ব্যাপার সে ছেলের কাছে আজও লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।
‘তোমার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়।’
যদি অসম্ভবই হবে তাহলে পারলাম কি করে? তোর জন্মেরও আগে ফণী পাল এসেছে এই সংসারে। একটা ভয়ের ছাতা সে ধরে রেখেছিল এই সংসারের মাথার উপর। তার ছায়ায় জীবনের সেরা সময়টা সে কাটিয়েছে। ফণী পাল মরে গেছে শুনে ভেবেছিল ছাতাটা এবার বন্ধ হল। কিন্তু ছাতাটা সে তুলে দিয়ে গেছে গৌরাঙ্গর হাতে।
প্রিয়ব্রত ঝাঁট দেওয়া ধুলো কাগজে তুলে সেটা পগাড়ে ফেলার জন্য ছাদে গেল। পাঁচিলের কাছে পৌঁছেই নীচের ছাদে তার চোখ পড়ল। খুদিকেলোর বউ তারে কাপড় মেলছে । শীর্ণদেহে আবরণ শুধু এলোমেলোভাবে পরা জ্যালজেলে ছাপা শাড়ি। কোনো অন্তর্বাস নেই । মুখ ও হাতদুটি তোলা। তাকে দেখতে পায়নি কিন্তু ওর শাড়ি ভেদ করে গোটা শরীরটা সে যেন দেখতে পাচেছ । সত্যিই পাচেছ, না একটা ইচছা তার মনে এইমাত্র প্রসব করল !
একেবারে নিরু! মাথার চুল, কপাল, নাক, থুতনি, কান, ঘাড়, গলা, কাঁধ, পিঠ, কোমরের ভাঁজ… প্রিয়ব্রত পাঁচিল থেকে পিছিয়ে এল। খুদিকেলোর বউ এইবার এদিকে ঘুরেছে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখল, তিলু কোথায়!
আগেও তো সে নিরুর মাকে দেখেছে, এইভাবে নয়। মানুষের মিল মুখের মধ্যেই খোঁজা হয় কিন্তু সে শরীরের মধ্যে খুঁজল কেন? …তাহলে নিরুকেই কি সে খুঁজছে!…হিতু কি এই খোঁজার কথাই বলতে চেয়েছে? ওকি আমার ভেতরটা দেখতে পায়!