প্রিয়ব্রত তাকিয়ে রইল। হিতুর চোখ কাগজের দিকে। লজ্জা পাচ্ছে চোখে চোখ রাখতে। ওর কি মনে আছে কাল কীভাবে বাড়ি ফিরেছিল?…’লাথি মেরে তোর-‘, কথাটা সে হিতুকে শেষ করতে দেয়নি। তিনকড়িকে তখন কি তার মনে পড়েছিল!
”তোমার কাছে শোনার পর কাল বিকেলে থানায় ফোন করেছিলাম মেয়েটার খবর জানতে।”
”মেয়েটা? …নিরু!”
”হ্যাঁ। ও সি-কে পেয়ে গেলাম। খুদিকেলো সকালে থানায় গিয়ে মেয়ের নিরুদ্দেশ হবার খবরটা দিয়ে আরও একটা কথা বলেছিল। ওর ছেলেবেলার বন্ধু, বাড়ির পেছনেই থাকে। সম্ভবত সে ওর মেয়েকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার ভুজুং দিয়েছে বলে ও সন্দেহ করছে।”
”আমি!”
”তোমার নামই করেছে। বলেছে লোকটার বউ মরে গেছে অনেকদিন, এখন ওর-।”
”এখন কি?” প্রিয়ব্রতর হাতের দশটা আঙুল বেঁকে শক্ত হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা নেমে যাচ্ছে পায়ের দিকে।
প্রশ্নটা যেন শুনতে পায়নি বা শুনেও বাতিল করল, এমন একটা ভাব নিয়ে হিতু বলল ”ও সি-র তখনই কিন্তু মনে হয় মিথ্যে বলছে, তাই উনি চেয়েছিলেন সন্দেহভাজন হিসেবে প্রিয়ব্রত নাগের নাম খুদিকেলো ডাইরিতে লেখাক। কিন্তু ও সেটা করতে রাজি হয়নি। ও সি তখন ওকে চেপে ধরেন, ‘কেন তাহলে এতবড়ো একটা বদনাম একজন বয়স্ক লোক সম্পর্কে দিতে চাইছেন? অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবেন?”’
”কী বলল খুদিকেলো?”
”তা আর আমি জিজ্ঞেস করিনি তবে ও সি শুধু এইটুকু বললেন, কেসটা যে চালানো যাবে না সেটা গোড়া থেকেই বুজে ছিলাম। লোকটা যেমন ধূর্ত তেমনি ভীতু। নিজেই মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে এখন পালিয়ে গেছে বলে রটাতে চাইছে আর সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য এক বয়স্ক বিপত্নীকের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। এইসব শুনে মাথাটায় এমন এক বিশ্রী অবস্থা তৈরি হয়ে গেল যে-।”
”ও সি কি জানেন প্রিয়ব্রত নাগ তোর বাবা?”
”জানতেন না, পরে বলেছি। বার দুয়েক ওর নাম আমাদের কাগজে বেরিয়েছে। আমার জন্যই তা হয়েছে এই ওর ধারণা।…কিন্তু একটা জিনিস বুঝছি না, খুদিকেলো তোমার সম্পর্কে এরকম কলঙ্ক ছেটাতে চাইল কেন?”
হিতু বিরক্তি, আর রাগ মেশানো বিশ্রী একটা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ব্রত চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইল, ওর মনের মধ্যে কী ধরনের কথা জমা হয়েছে।…অভিযোগ, কেন এত দুর্বল চরিত্র? কিন্তু হিতু তো জানে, মেয়েমানুষের জন্য লোভ থাকলে বহু বছর আগেই বিয়ে করতে পারতাম। খুদিকেলো কেন কলঙ্ক ছেটাতে চাইছে তার কারণ আমি কী করে বলব? সেদিন মৌলালিতে বৃষ্টির সময় দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে কিংবা চা-শিঙাড়া খেতে খেতে বা বাসে আসার সময় আমার কথাবার্তা, চাহনি, আচার-আচরণ, হাবভাবের মধ্যে এমন কিছু ফুটে উঠেছিল কি যাতে খুদিকেলোর মনে হতে পারে নিরুর প্রতি আমার…।
”তুই বিশ্বাস করিস?”
হিতুর চোখে যেন ছায়া পড়ল, ভেসে গিয়ে ছায়াটা আবার ফিরে এল। কী ভাবছে?
হিতু মাথা নাড়ল। ”না।”
তাহলে? প্রিয়ব্রত ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসল। বুকের মধ্যের গুমোটটা কেটে যাচ্ছে। হালকা লাগছে চেয়ারের পিঠে ঠেশান দিয়ে সে বুঝতে পারল একটা পাতলা হাসি তার ঠোঁটে ভেসে উঠেছে।
”না, তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।…তোমার পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। সেইজন্যই তো ভেবে পাচ্ছি না, খুদিকেলো লোকটা তোমার সম্পর্কে এইরকম কথা বলতে চাইল কেন!”
কিছুই সম্ভব নয়…এতই অক্ষম! তাহলে এতগুলো বছর ধরে ওকে যে এতবড়োটা করে তুললাম, সেটা কি একটা কিছু করা নয়? তাহলে মদ খেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে বাবাকে ‘লাথি মেরে ফাটাব’ বলাটাই হল পুরুষমানুষি কাজ? যার লোভ সামলাতে না পারাটাই হল বিদ্যের বহর?
”চাইল কেন তার আমি কি জানি।” টেবিলে কিল বসিয়ে প্রিয়ব্রত চেঁচিয়ে উঠল। হিতু এই প্রথম তার বাবাকে চোখ বিস্ফার করে রেগে উঠতে দেখল। ”আমি কি খুদিকেলোর মনের খবর রাখি?”
”শুধু শুধুই বলল?”
”হ্যাঁ শুধুশুধুই। একটা অভাবী লোক, সংসারে দ্বিতীয় কোনো রোজগেরে নেই, সদাসর্বদা ভাতের চিন্তা,…আইবুড়ো পাঁচটা মেয়ে, মেয়েদের লেখাপড়া শেখায়নি, ক্ষয়া চেহারা, বিয়ে দিতে পারবে না,…এইরকম লোকেরাই নীচ হয়, ঈর্ষাকাতর হয়। আমি স্বচ্ছন্দে আছি ওটা ও সহ্য করতে পারছে না।”
”তুমি স্বচ্ছন্দে আছ? একটা সক্ষম পুরুষমানুষ বিনা স্ত্রীলোকে স্বচ্ছন্দে আছে?…থাকতে পারে? সম্ভব? বিশ্বাস করতে হবে?”
”হিতু এইভাবে কোনো ছেলে বাবার সঙ্গে কথা বলে না।”
”সরি।” হিতু কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরল। ঠোঁটের কোণ মোচড়ানো। চোখে অশান্তি।
”আগে কিন্তু এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতিস না। চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই তুই বদলেছিস।”
”তুমি বলতে চাও যতদিন আমি তোমার হাততোলা হয়েছিলাম ততদিন বাধ্য থেকেছি। আর এখন রোজগার শুরু করে তোমার সমালোচনা করছি? …কিন্তু একটা কথা বুঝছ না কেন, আমারও বয়স বাড়ছে সেইসঙ্গে বিচার ক্ষমতাটাও।”
”তুই আমার বিচার করবি! আমি ভালো কি মন্দ, সেই রায় দিবি?”
”আহহা, এভাবে কেন কথাটা নিচ্ছ? প্রত্যেক মানুষই অন্য মানুষকে খতিয়ে দেখে অবশ্য যদি তার খতাবার মতো মাথা থাকে। খুদিকেলোও তোমাকে খতিয়েছে আর তার মনে হয়েছে, তুমি ওর মেয়েকে ফোসলানি দিয়েছ বললে লোকে অবিশ্বাস করবে না।”
”মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা।”