প্রিয়ব্রত দেখল জ্যাঠামশাইয়ের বারান্দায় ঘোমটা দেওয়া কে এসে দাঁড়াল আর আলোটাও নিভে গেল। অন্ধকার গলি দিয়ে গুপী বসাক লেনের আলোটা ব্যাটারি ফুরিয়ে আসা টর্চের মতো দেখাচ্ছে।
”চল।”
”কোথায়, কেন, কীজন্য?…আগে জবাব দে, দরজা খুলতে এত দেরি করলি কেন? টাকা দেখাচ্ছিস?…স্কচ?…শালা, লিখতে পারি, খাটতে পারি, চাকরি আমাকে তাড়া করবে। ইংরিজিটা আমি শিখেছি।…তোর মতো গোরু নই।”
ঝটকা দিয়ে হিতু হাতটা সরিয়ে দুলতে লাগল।
”হিতু ওপরে চল।”
”চোপ শালা, আমি কি ডিসঅনেস্ট জার্নালিস্ট যে মদ খাইয়ে আমাকে হাত করবি? প্রেস কনফারেন্স! মুতে দি তোর কনফারেন্সের মুখে…তোর মতো চোর, স্মাগলারদের বক্তব্য আমি এই হাত দিয়ে টাইপ করব ভেবেছিস?…বল শালা কেন দরজা খুলতে দেরি করেছিস? না বললে লাথি মেরে ফাটাব তোর-”
”হি-ও-উ-উ -‘ দাঁতে দাঁত চেপে প্রিয়ব্রত চাপা চিৎকার করেই দুহাতে জামার কলার ধরে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে হাঁচকা টানে ওকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। সদর দরজার পাল্লাদুটো বন্ধ করার শব্দে জ্যাঠামশাইদের অন্ধকার দোতলা থেকে কে বিরক্তি প্রকাশ করল।
অন্ধকার জায়গাটায় হিতু যে কোথায় দাঁড়িয়ে সে বুঝতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে কীরকম একটা ওলটপালট ঘটছে। জোরে টানটা দিয়েছে। হিতু হুমড়ি দিয়ে ঢুকে এল ভিতরে, কিন্তু কোথায়? সে দুহাত বাড়িয়ে বলল, ”হিতু।”
দুটোহাত সে, ডুবন্ত মানুষের কিছু একটা আঁকড়াবার চেষ্টার মতো দুধারে নাড়ল অন্ধকার থাবিয়ে। কোথায় ও?
”হিতু?”
সন্তর্পণে এক পা এগিয়ে সে আবার দুহাত বাড়াল। অন্ধকার শূন্যতাকে সরিয়ে চাইল, রক্ত, মাংস দিয়ে ভরাট একটা তপ্ত অবয়বকে স্পর্শ করতে।
কি হল? হিতু কি মিলিয়ে গেল!! মাথার মধ্যে এসব কি ঘটছে? দুঃস্বপ্নেই তো এইরকম পরিস্থিতি দেখা যায়। তাহলে কি হিতুটা মরে গেল?
প্রিয়ব্রত আলোর সুইচের দিকে যাবার জন্য উঠোনের দিকে এগোতে যাবে তখনই আলো জ্বলে উঠল।
”বাবু, দাদা কি এসেছে?”
প্রিয়ব্রত মাথা নীচু করে দেখল, বুকের কাছে হাঁটু জড়ো করে কাত হয়ে হিতু ঘুমোচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে বাহুটা। ঝুঁকে নিচু হয়ে সে হিতুর কপালে হাত রাখল। শান্ত, কোমল মুখটি গাঢ় ঘুমের ছায়ায় বাচ্চচা ছেলের মতো লাগছে। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে জিভ দেখা যাচ্ছে।
”তিলু তুই পায়ের দিকটা ধর ওকে ওপরে নিয়ে যাই।” প্রিয়ব্রত হাতের চেটোয় লাগা ঘাম বুকে মুছল।
তিনতলায় হিতুকে বিছানায় শুইয়ে সে জুতো মোজা খুলে, ভিজে কাপড়ের মতো পায়ে থাকা ওর হাত দুটো বুকের উপর জড়ো করে তুলে দিল।
”যদি তুই তাড়াতাড়ি নেমে দরজা খুলে দিতিস তাহলে আর চেঁচাত না।”
”ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।”
প্রিয়ব্রত নিজের ঘরে এসে খাটে বসল। শূন্যদৃষ্টিতে ঘরের এধার ওধার তাকাল। সিনেমার পর্দার মতো তার মাথার মধ্যে এখন দ্রুত বেগে চলে যাচ্ছে আলো জ্বলা ট্রেনের জানলার সারি। এক-একটা ঘটনা, কিছু কথার শব্দ, মন্তব্য, ভঙ্গি, হাসি, রাগ, বায়না জানলাগুলো দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে। একসময় ট্রেনটা শেষ হয়ে গিয়ে পর্দাটা সাদা হয়ে গেল।
প্রিয়ব্রত ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু দু-তিনবার তার ঘুম ভেঙে যায়। আধা তন্দ্রার মধ্যে সে মনে করার চেষ্টা করছিল…ট্রেনটা যে লাইন দিয়ে যাচ্ছে তার শেষে আছে একটা ভাঙা ব্রিজ। অথচ বিকট একটা শব্দ হল না, কিন্তু ভেঙে পড়ছে দরজা, জানলা, ছাদ, বেঞ্চ। চাকা ছিটকে যাচ্ছে, লাইন দুমড়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের নীচে শুধু একটা মানুষ! বুকে একটা ব্যথা সারাক্ষণ ঘুমের মধ্যে তাকে কষ্ট দিচ্ছিল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই সে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। কেউ যেন সিগারেটের ধোঁয়া আকাশের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়েছে, এমনভাবে মেঘগুলো কুণ্ডুলি হয়ে রয়েছে। কান পেতে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। বাসন নাড়ানাড়ি ছাড়া তিনতলায় এই সময় আর কোনো শব্দ হয় না। পাশের বাড়ি থেকে রেডিয়োয় গান ভেসে আসছে, তারমধ্যেই একটা বাচ্চচার তারস্বরে কান্না আরও উঁচু পর্দায় উঠল চটাস চটাস তিনটি শব্দের পর। জানলার কাছাকাছি একটা কাক ডেকে উঠল। অন্যান্য দিনের মতোই একটা সকাল।
মুখ ধোবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েই চোখাচোখি হল হিতুর সঙ্গে। খাবার টেবিলে বসে। এক হাতে খবরের কাগজ, পাশে আরও দুটো কাগজ, অন্য হাতে চায়ের কাপ। হিতু চোখ সরিয়ে আবার কাগজে রাখল। সকালে ও বিছানায় আধশোয়া হয়েই চা খায়, আজ কেন ঘরের বাইরে খাচ্ছে? হিতু কি তাকে কিছু বলার জন্য বসে রয়েছে? ওর চাউনির মধ্যে একটা ঠান্ডা ভাব। সে কি আশা করেছিল লজ্জা মেশানো কুণ্ঠা থাকবে! হিতু তো অন্যায় করলে বরাবরই সেটা স্বীকার করে! মুখ ধুয়ে প্রিয়ব্রত টেবিলেই বসল হিতুর মুখোমুখি। একটা কাগজ টেনে নিল।
শ্রীলঙ্কা, আই পি কে এফ, তামিল টাইগার্স…কোকরাঝোর বম্ব ব্লাস্ট…পাঞ্জাব, ফাইভ পারসনস শট ডেড বাই…নিউ প্ল্যান টু ফাইট কম্যুনাল এলিমেন্টস…আফগান ফাইটিং…টু মার্ডারড, গ্রুপ ক্ল্যাশ,…টকস ফেইল…ইয়েট টু রিভাইস পে স্কেল,…পাওয়ার সাপ্লাই ইমপ্রুভস,…সেমিনার অন ড্রাগ অ্যাবিউস…ফুডগ্রেইনস প্রাইস হাইক…।
কাগজটা রেখে সে অন্যটা তুলতে যাচ্ছে তখন হিতু বলল, ”একটা কথা বলব।”