সিঁড়ি দিয়ে নেমে, একতলায় ল্যান্ডিং পেরিয়ে গেটের দিকে যাবার সিমেন্ট বাঁধানো পথটায় পৌঁছতে কতটা সময় লাগার কথা? প্রিয়ব্রত বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে গৌরাঙ্গকে দেখতে পেল না। তাহলে সিঁড়িতেই বোধহয় ভৌমিক ওকে ধরেছে।
‘শুনুন। আপনার বাবা মাসের পয়লা তারিখে টাকা নিতে আসতেন অতুল ঘোষের কাছে। এবার উনি-‘
‘মারা গেছেন, ক্যানসারে।’
‘কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘করুন।’
‘আপনার বাবাকে উনি কেন টাকা দিতেন?’
‘বাবা ওর কাছে টাকা পেতেন।’
‘অতুলদা বলেছিলেন, খুব অভাব আপনার বাবার, সংসার চালাতে পারেন না, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে-‘
‘মিথ্যেকথা। অভাব কোন সংসারে নেই? কিন্তু তা বলে সংসার চলত না, এটা মিথ্যে কথা। উনি একথা বলে থাকলে মিথ্যা বলেছেন। আসলে ওনার আগাগোড়াই মিথ্যা, ভান…জীবনটাই ভণ্ডামির উপর দাঁড়িয়ে। ওকে দেখছেন, ওর সম্পর্কে যা জেনেছেন আসলে-‘
‘আপনার কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছি না! অতুলদা আসলে তাহলে কী?’
গৌরাঙ্গ কি বলে দেবে, অতুলচন্দ্র ঘোষ আসলে কে? বোধহয় বলবে না। বলে দিলেই মাসে মাসে পাঁচশো বা থোক পঁচিশ হাজার আর পাওয়ার আশা থাকবে না। গৌরাঙ্গ এমন বোকামি নিশ্চয় করবে না। পাবে না, এটা নিশ্চিতভাবে জানার জন্য ও অপেক্ষা করবে। প্রতিদিন আসবে, এই টেবিলের ওধারে বসে অনুনয় করবে, হুমকি দেবে-সবই চাপা গলায়, সরল মুখে।
কিন্তু ওরও তো ধৈর্যের সীমা আছে!
. মোটরবাইকের শব্দটার জন্য সে অপেক্ষা করছে। না শোনা পর্যন্ত তার ঘুম আসবে না।…কটা বাজে এখন? জ্যাঠাদের বাড়িতে একটা জাপানি ওয়াল ক্লক ছিল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজত। এই ঘর থেকেও শোনা যেত রাত্রে। বছর দুই হল আর সে শুনতে পাচ্ছে না। তার থেকেও ঘড়িটার বয়স বেশি, জ্ঞান হওয়ার পরই তো সে ওটা দেখেছে। আট টাকায় জ্যাঠামশাই নীলামে কিনেছিলেন। কেনার পর একবারও অয়েল করতে হয়নি, একবারও শ্লো বা ফাস্ট হয়নি! একইভাবে চলেছে, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড…এভাবে কোনো মানুষের পক্ষে চলা যায় না।
একভাবে, একইভাবে…একটা মিনিটও, একটা সেকেন্ডও এধার ওধার হবে না, যে দেখবে যে শুনবে অবাক হয়ে যাবে…’কী দারুণ ঘড়ি! কী অদ্ভুত ঘড়ি!’…কই কেউ তো একবারও বলল না ‘ছাব্বিশটা বছর একভাবে, ভয়ের মধ্যে কাটাল! এখনও লোকটা পাগল হয়নি…কি অদ্ভুত!’
চণ্ডীগড়ের প্রোফেসার গুপ্তাও কি এইরকম ভাবছে? লোকটার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করত, ‘এভাবে মানসম্মান সংগ্রহ করে শেষপর্যন্ত কী জুটল?’ গৌরাঙ্গকেও জিজ্ঞাসা করা যায়, ‘এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে কি আপনি নিজেকেই অপমান করছেন না? আপনারও তো আত্মা আছে।’
লোকটা স্কুলমাস্টার, কিছুটা লেখাপড়া করেছে, পাঠ্যবই ঘাঁটে। তাতে অনেক ভালো, গভীর, মহৎ কথা আছে, সেগুলো ছাত্রদের বুঝিয়ে ব্যাখ্যা করে দিতে হয়। আমার কথাটা নিয়ে হয়তো ভাববার ইচ্ছা হলেও হতে পারে। ভাবতে ভাবতে হয়তো এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যখন ওর মনে হবে-আর না, লোকটা তো যথেষ্ট শাস্তিই পেয়েছে। এবার ওকে ক্ষমা করে দেওয়া যাক। চাকরির জীবন তো প্রায় মেরেই এনেছে, এবার লোকটা স্বস্তি পাক।
কলিং বেল বেজে উঠল।
হিতু এল কি? মোটরবাইকের শব্দ তো কই পেলাম না! প্রিয়ব্রত উৎকণ্ঠায় টান টান হল। তিলুর পায়ের শব্দটা নীচে নামছে না। ঘুমিয়ে পড়ল কি? রাত কটা এখন?
আবার কলিং বেল বাজল। পরপর তিনবার। যে বাজাচ্ছে সে জানিয়ে দিচ্ছে, খুবই ব্যস্ত। বিছানায় উঠে বসল প্রিয়ব্রত।
এবার কড়া নাড়ার শব্দ। অধৈর্যতা এবার বিরক্তির জানান দিল। প্রিয়ব্রত খাট থেকে নেমে ছুটে গেল ছাদের পাঁচিলে। জ্যাঠামশাইদের বারান্দার আলো জ্বলছে। বোধহয় এইমাত্র জ্বালানো হল। পাঁচিলে ঝুঁকে সে দেখল হিতু দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে আর একজন। কিছু কি হয়েছে নাকি!
”যাই-ই-ই।”
প্রিয়ব্রত দ্রুত নেমে এল। সিঁড়িগুলো মুখস্থ। মোট তেত্রিশটা সিঁড়ি, তিনটে বাঁক নিলেই একতলা। আলো জ্বালার প্রয়োজনই তার নেই। এখন এটা তার মনেও পড়ল না। হিতুর সঙ্গে আবার লোক কেন? অ্যাকসিডেন্ট করেছে কি! মোটরবাইকের শব্দটা সে পায়নি।
বাইরে থেকে লাথি মারার শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সে দরজা খুলল। কোমরে দুহাত রেখে হিতু দাঁড়িয়ে। বারান্দার আলোটা পিছনে থাকায় ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। গোড়া কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার মতো সঙ্গের লোকটি দু’হাতে ওর কাঁধ ধরে রয়েছে।
”দরজা খুলেছে, এবার ভেতরে যা…ওকে আপনি একটু ধরে নিয়ে যান।” লোকটি নীচু গলায় ব্যস্তভাবে বলল।
প্রিয়ব্রত একে কখনো আগে দেখেনি।
”দরজা খুলতে এত দেরি হল কেন রাসকেল?”
হিতু সামনে ঝুঁকে পড়ে যাচ্ছিল। লোকটি কাঁধ ধরে সোজা করে দিল।
”কী হয়েছে?” প্রিয়ব্রত বিভ্রান্ত গলায় জানতে চাইল। তার সারাদেহ থরথর কাঁপছে।
”কিছু হয়নি, একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে…নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিন, সকালে ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলি, ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে।”
”ওর মোটরকবাইকটা?” প্রায় আর্তনাদ করে উঠল প্রিয়ব্রত।
লোকটি তিনচার পা এগিয়ে গিয়েছিল। থমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ”অফিসের সামনে রাস্তায় রাখা আছে। লোকজন রয়েছে, চুরি যাবে না।”