রমা বোঝে যমুনার স্বচ্ছল অবস্থাকে সহ্য করতে পারে না মাধবী। তাই রাগ উসকে ওঠে। কিন্তু দায়ে-অদায়ে, টুকিটাকি সাহায্যের জন্য হাত পাততে হয়। রাগ আর অনুগ্রহ চাওয়া, এই দু’য়ে মিলে মাধবী শুধু ভদ্র সম্পর্কটুকুই রাখতে চায়। আর যতটুকু ঘনিষ্ঠ হলে এই সম্পর্ক বজায় থাকে তার বেশিতেই মাধবীর শাসন। তাই দরকার না পড়লে যমুনার ঘরে আসার উপায় নেই।
-কি, বলে গেল কিছু?
ফিতেটাকে দাঁতে চেপে আয়নায় চোখ রেখে যমুনা জিগ্যেস করল। রমা হাসল। কাপগুলো সাজিয়ে রাখল তাকে। ফিরে দাঁড়াল যমুনা।
-নাকি এবারেও সেই আগের মতন। পরে চিঠি দিয়ে জানাব!
মাথা নাড়ল রমা। তাতে হ্যাঁ এবং না দুই-ই বোঝায়। যমুনা কি বুঝে শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। রমা দরজার দিকে তাকাল। অস্বস্তি ভোগ করার আগেই সে চলে যেতে চায়।
-যাই বৌদি। কাজ পড়ে আছে।
-উনি বলছিলেন চুঁচড়ো না কোথায় যেন একটা মেয়ে জলে ডুবে মরেছে।
-কেন!
-বাপ-মাকে রেহাই দেবার জন্য। এখনো এসব হয়।
-যাই বৌদি।
-আমার বেলায় হয়েছিল কি, যারাই দেখেছে পছন্দ করেছে। কিন্তু বাবার এক গোঁ, কারুর খাঁই মেটাব না। মেয়েতো কুচ্ছিত নয়।
হাসল যমুনা। পানখেয়ে দাঁতগুলোকে ফোকলা দেখায় এই অন্ধকার-অন্ধকার আলোতে। নয়তো মুখের গড়ন ভাল।
-তোমার দাদা নিজে এসেছিল আমায় দেখতে।
হাতের প্যাঁচে চুলগুলোকে কায়দা করে ফেলল যমুনা। বেশ ঘন চুল। রমা তাকিয়ে রইল চুপ করে।
-পাত্তর নিজে আসে নি?
-কি জানি।
-আহা, ন্যাকা! দেখলেই তো চেনা যায়।
হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল রমা। উঠোনের একধার দিয়ে একটা গলি এঁকেবেঁকে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে। গলিতে কোন দরজা নেই। তাই উঠোনের কোন আব্রু নেই। বাইরের লোক যে কোন সময় হুট করে এসে পড়তে পারে। নতুন মেয়েরা প্রথমে অস্বস্তিতে ভোগে। ফেরিওয়ালারা একদম উঠোনে এসে হাঁক দেয়। পরিচিত হলে দরজায় এসে দাঁড়ায়।
মাথা নিচু করে সার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বিশ্ব আসছিল। গলি আর উঠোনের মুখে পাল্লা-ভাঙা লেটার-বক্সটা দেখতে সে মুখ তুলল। চিঠি আসে নি কিন্তু রমাকে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ভাঁজ পড়ল তার।
বিব্রত হয়ে চারপাশ তাকাল রমা। বিশ্বর হাসিটা চোখে পড়ার মত। তবু রক্ষে, ধারে কাছে এখন কেউ নেই। উঠোন থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে সুস্থ মানুষের অতখানি সময় নেওয়া চোখে পড়ার মত। রমা আবার যমুনার ঘরে ঢুকে পড়ল। বিশ্ব আবার সার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, মাথা নিচু করে তার স্বাভাবিক গতিতেই তিনতলায় উঠে গেল। মা আর বিধবা দিদিকে নিয়ে সে থাকে।
-কি?
-কাবেরী আবার কবে আসবে?
কাবেরী যমুনার বোন। দিদির কাছে এসে সে মাঝে মাঝে থাকে।
-এই তো ক’দিন আগে গেল, কলেজের ছুটি না পড়লে আর আসবে কি করে।
-তার মানে সেই পুজো?
-হুঁ। ও বুঝি তোর দাদার একটা গল্পের বই নিয়ে গেছে?
-কি জানি।
-হ্যাঁ। বলেছে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।
-আচ্ছা বলব।
চলে যাচ্ছিল রমা। যমুনা ডাকল।
-কে চুল বেঁধে দিয়েছে রে?
-নিজেই।
-আহা বাঁধার কি ছিরি। মাথা ঘষিস নি ক’দিন?
-কাল পরশু ঘষব।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল রমা। দালানে পা দিয়েই মাধবীর গলার স্বর কানে এল।
-দোতলার বড়বৌয়ের ভাইপো। মাস ছ’য়েক হল চাকরিতে ঢুকেছে। বাপের এক ছেলে। বাড়ি আছে। অবস্থা ভাল।
-খরচ পত্তরের কথা বলেছে কিছু?
-আগে মেয়ে দেখুক, তারপর তো কথা হবে। চাকরে ছেলে, খাঁইতো থাকবেই। তোমার চাকরিরই বা আর ক’দিন, এই বেলা দেখেশুনে মেয়ের বিয়ে না দিলে মুশকিলে পড়তে হবে। শরীর তো দিনকে দিন ভেঙে পড়ছে।
যেমনভাবে ঢুকেছিল তেমনি চুপিসাড়ে রমা তিনতলার সিঁড়ি ধরল। ওরা কথা বলছে। সংসারের দরকারি কথা। আপাতত ভুলে থাকবে সব কিছু। থাকুক। ততক্ষণে তিনতলাটা চট করে ঘুরে আসা যায়। মাধবী খোঁজ করার আগেই। এখন বিকেল। এখন সংসার থেকে একটু ছুটি। খোঁজ করলেই বা, এ সময়টা আমার নিজের। তরতরিয়ে সিঁড়ি ভাঙল রমা। প্রতিটি ধাপই ক্ষওয়া, ভাঙা, পা ফেললেই পড়ে যাবার ভয় আছে। চারটে বাঁক নিয়ে সিঁড়িটা ছাদে পৌঁচেছে।
বিশ্বদের দরজাটা খোলা। ঝাঁট দেওয়ার শব্দ আসছে। বিশ্বর দিদি এখন সংসারের কাজে ব্যস্ত। ভালই হয়েছে। দরজাটা এড়িয়ে ছাতে এল রমা।
চারতলা বাড়িটার পাশে একটা বটগাছ। ওই দিকে সূর্য ডুবেছে। গাছের মধ্যে অজস্র আলোর ঘুলঘুলি। কাক নাচানাচি করছে গাছে। কালো কালো মাথা যেন পরের বাড়ির উঠোনে উঁকি দিচ্ছে। তারপর কোথায় কি ঘটল। হুস হুস করে কাকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। দু’একটা রমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
মেয়েরা বেড়াচ্ছে, গল্প করছে ছাতে। ছাতগুলো দূরে দূরে। কথা বলতে হলে চীৎকার করতে হবে। তাছাড়া আলাপও নেই, নিত্যি নতুন ভাড়াটে আসছে-যাচ্ছে। বাড়ি বয়ে ভাব করতে কে যায়! তাছাড়া চাইলেই বাড়ি থেকে বেরোন অত সোজা ব্যাপার নয়। উঠতি বয়সী মেয়ে, হট হট করে এবাড়ি সেবাড়ি করবে, সেটা মাধবী পছন্দ করে না।
মেয়ে দুটো হেসে গড়িয়ে পড়ল। আবার ছুটে এল পাঁচিলে। দুখানা বাড়ির পরের ছাতে, চা খাচ্ছে একটা লোক। মুচকে হাসছে। দুটো মেয়েই স্কুলে পড়ে। রমা প্রায় দিন ছয়েক হল লোকটাকে চা খেতে দেখছে।
পাঁচিলে একসার শিশি। গামছা পরে এক মাঝ-বয়সী বৌ ওগুলো তুলছে। দূর থেকে দেখেই দাঁত সিরসির করে। অনেক দূরে আর একটা বাড়িতে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। আজ সকালেই শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। গায়ে হলুদ হল বোধ হয়।