চেয়ারে বসেই হাতের কাছে যে বইটা পেল তুলে নিল দিনেশ। বিবেকানন্দের চিঠি। কয়েক পাতা উলটিয়ে আর একটা তুলল। শরৎ গ্রন্থাবলী। মনযোগ করল।
এখন রাগ করে কোন লাভ নেই তবু রাগ হল মাধবীর। দিনেশের দোষ নেই। তারা যদি রমাকে না পছন্দ করে তাহলে কি-ই বা সে করতে পারে। কিন্তু একটা কিছু তো করা উচিত। মুখ বুজে বই পড়লেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিছু না পারুক অন্তত ভাবুক। চেঁচিয়ে সেই ভাবনার কথাটা জানাক। যত ভাবনা একাই ভেবে মরব; ওর কি কোন দায় দায়িত্ব নেই। সংসার খরচের কটা টাকা ফেলে দিয়েই খালাস! ঘাড় গুঁজে বই পড়ছে কেমন নিশ্চিন্তে। এতবড় যে একটা বোঝা ঘাড়ে চেপে আছে সে খেয়াল নেই। অন্যের ভাবনা বইয়ে লেখা আছে। তাইতে ডুবে গেছে। অন্যের ভাবনা ভেবে কি লাভ!
মাধবী শব্দ করে দরজায় খিল দিল।
সেই শব্দে আর একবার কেঁপে উঠল রমা। চোখ বুজে এল। এবারেও তাকে অপছন্দ করেছে। এই নিয়ে দু’বার হল। লজ্জা করছে। সেজেগুজে কতকগুলো অপরিচিত লোকের সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা। বাঁধা মামুলি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আর মায়ের রাগ দেখা। এত করেও কিছু হল না। আমার জন্যই মা রাগে, বাবা মাথা গুঁজে বই পড়ে। এখনকার এই মনকষাকষি, অশান্তি আমার জন্যেই। আমায় অপছন্দ করেছে, তার মানে ওদের চোখে আমি কুচ্ছিত। নিজেকে কুচ্ছিত ভাবতে লজ্জা করে। এ খবর পাঁচজনে শুনলে নানান কথা বলবে, দয়ার কথা।
আয়নার সামনে দাঁড়াল রমা। জায়গায় জায়গায় পারা উঠে শুকনো পোড়া ঘায়ের মত দাগ ধরে আছে। খোঁপায় আঙুল চেপে কাঁটাগুলো বসিয়ে দিল। আয়নার আধখানা কাচ অদ্ভুত। মুখটা লম্বাটে দেখায়। দেখলে ভয় করে। হয়তো ভয় পেয়েছিল। ঘরে ঢুকেই ভ্রূ তুলল মাধবী।
-কাপ ডিশগুলো তখন থেকে ও ঘরে পড়ে রয়েছে, পরের জিনিস ফেরত দিতে হবে না।
তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোচ্ছিল রমা। আরো বিরক্ত গলায় মাধবী বলল-
-কাপড়টা ছাড়বি কখন?
খেয়াল হল রমার। কাপড়টা আগেই তুলে রাখা উচিত ছিল। লোকজনের সামনে বেরোবার মত এই একখানাই শাড়ি আছে। যদি দাগ ধরে বা ছেঁড়ে! এবার গলার স্বর ইচ্ছে করেই চড়িয়ে মাধবী বলল।
-বাহার দেওয়া হচ্ছে। যেন হাজার গণ্ডা শাড়ি কিনে দিয়েছে। তোলাগুলো পরে পরে আর একখানাও তো আস্ত নেই।
-এই একখানাই তো তোলা শাড়ি! আর ছিল নাকি?
-থাকবে কি করে? আমার বাপ তো তোর বাপের মত নয়, তোরঙ্গ ভর্তি করে শাড়ি দিয়েছিল। দিতে জানা চাই, বুঝলি-
মাধবী এই যে শুরু করল, যতক্ষণ না দিনেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে আর থামবে না। প্রতিদিনের ঘটনা। একটা ছুতো পেলেই হয়। রমা তাড়াতাড়ি বদলে নিল শাড়ি। তোরঙ্গের শেষ তলাতে পাট করে বিছিয়ে রাখতে হবে। রমার হাত থেকে মাধবী সে কাজটুকু তুলে নিল।
পাশের ঘরে এসে রমা ঢুকল। দিনেশ বেরিয়ে যায়নি। ছুটির দিন আজ। বিকেলের আলোও যাই যাই শুরু করেছে। জানলা থেকে টেবিল পর্যন্ত শুধু স্পষ্ট নজর করা যায়। নয়তো চোখ টান করে বাকি ঘরটুকুতে তাকাতে হয়।
মাথা ঝুঁকিয়ে বই পড়ছে দিনেশ। মাধবীর কথাগুলো নিশ্চয় কানে গেছে।
-বাবা, বাইরে যাবে না?
নরম গলায় বলল রমা। কিন্তু তাই বলে এত নরম নয় যে উত্তর পাওয়া যাবে না।
-বিকেল হয়ে গেছে। একটু ঘুরে এসো।
এবার পাশে দাঁড়িয়ে রমা বলল। একটু বেশি রকমের চমকাল দিনেশ। রমা বুঝল এতক্ষণ বই পড়ছিল না।
-বেশ লাগছে পড়তে।
-ওতো তোমার কতবার পড়া বই।
-তবু বেশ লাগে। এক একবার, এক একরকম লাগে।
হাসল দিনেশ। বড় ঠাণ্ডা হাসি। রমার কষ্ট লাগে এই ছোটখাট মানুষটার জন্য। কটুকাটব্যগুলো নির্বিবাদে হজম করেও হাসতে পারে। তখন চোখে চোখ রাখলে মন জুড়োয়। মন খারাপও হয়। হাসির কথায় হাসে না। হাসবেই বা কোত্থেকে। সংসারে হাসির কথা হয় নাকি!
দিনেশ তাকিয়ে আছে। ঘরের আলো এখন অনেক কম। তবু মুখের দিকে তাকান যায় না। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। চোখ সরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল রমা।
দরজা পেরোলেই সরু একফালি জায়গা। একধারে ওপরে যাবার সিঁড়ি। আর একধারে উঠোন। সিমেন্টের রক উঠোন ঘিরে। রকের ধারে আর দুটো ঘর। যমুনারা থাকে।
উঠোনের একধারে কলতলা। বাইরে আর ভেতরে দুটো চৌবাচ্চচা পুরুষ আর মেয়েদের জন্য। মেয়েদেরটা পাঁচিলঘেরা টিনের চালা দেওয়া। বাসন মাজার কাজে বাইরেরটার ব্যবহার হয়। কাপগুলো ধুয়ে যমুনার দরজায় এসে রমা দাঁড়াল।
চুল বাঁধছিল যমুনা। ভেতরে ডাকল সে রমাকে। ছিমছাম থাকতে যমুনা ভালবাসে। ছেলেপুলে হয়নি। সে আর স্বামী। স্বামীর রোজগার ভাল। খাট, পুরু গদী, আয়না লাগান আলমারি, ঘেরাটোপে ঢাকা সুটকেশ, সবকিছুই এবাড়ির অন্যদের থেকে সিজিল-মিছিল। নিজেকেও যমুনা সাজগোজে অন্যদের থেকে তফাত করে রাখে। আজ তিন বছর আছে, তবু কেউ মন খুলে ওর সঙ্গে মিশতে পারল না।
মাধবী যমুনাকে পছন্দ করে না। কিন্তু মুখে তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলে না। ওর ঘরে রমার যাওয়া সে একদম পছন্দ করে না। কিন্তু মুখ ফুটে বারণও করেনি। যমুনার গ্রামোফোন আছে। গানগুলো রমার মুখস্থ। গুনগুনিয়ে দু’একটা কলিতে সুর তুললেই কপালে ভাঁজ ফেলে মাধবী তাকায়। রমার গান থেমে যায়। দু’একবার চুল বেঁধে দিয়েছিল যমুনা নতুন কায়দায়। মাধবী অবাক চোখে তাকিয়েছিল খোঁপার দিকে। রমা আর চুল বাঁধেনি যমুনার কাছে। সিনেমা দেখে এসে গল্প বলে যমুনা। এমন করে বলে যেন চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে রমার। কিন্তু মুখ ফুটে মাধবীকে বলতে সঙ্কোচ হয়।