চিনু পাশ ফিরে শুল, যাতে না মাধবীর মুখ দেখে আরো বিরক্ত হতে হয়।
-চেষ্টা চরিত্তির ক’রে একটা ভাল ছেলে দেখে দে’না। উনি চাকরিতে থাকতে থাকতেই কাজটা চুকে গেলে নিশ্চিন্তি।
নিশ্চিন্তি মাধবী একার জন্য চায় না। চিনু নরম সুরে বলল।
-লেখাপড়া শেখেনি, তার ওপর বুদ্ধিশুদ্ধিও কম।
কথাটা বলেই দুঃখ পেল। রমা ঘরে নাই। শুনলে হয়তো আড়ালে কাঁদবে। বোকারা বেশি অভিমানী হয়। কিন্তু কথাটা সত্যি।
-তাছাড়া টাকা-পয়সা খরচ করবার ক্ষমতাও তো আমাদের নেই।
এইটুকু বলে চিনু যেন অনুপস্থিত রমাকেই সান্ত্বনা দিল। মেঝেয় শুয়ে আছে মাধবী। চোখ জোড়া উপর দিকে স্থির নিবদ্ধ। চিনুও তাকাল। কড়ি-বরগার কাটাকুটি জংশন ষ্টেশনের মত। কালকের কাগজে কোথায় যেন দুর্ঘটনার খবর ছিল। মুখোমুখি ধাক্কা দিয়েছে। চুরমার ইঞ্জিন দুটোর ছবি দেখে ভয় করে। দুর্ঘটনার জন্য দোষী কে? কে জানে। তদন্ত কমিশন সাক্ষিসাবুদ নিয়ে তার বিচার করুক। যে কোন জিনিস সে যন্ত্রই হোক আর মানুষই হোক, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পথে চলতে হয়। না হলে অনিবার্য ধাক্কা লাগবেই। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের চলার নির্দিষ্ট পথ কোনটে? হাজার পথ, হাজার চলার ঢঙ। তাহলে মাধবীর সঙ্গে তার ঠোকাঠুকি লাগে কেন? এ বয়সে এমন ক’রে গায়ে ফুঁ দিয়ে, সংসারের দায়িত্বকে অস্বীকার করে চলাটা নিশ্চয় ভুল। তা’হলে ঠিক পথ কোনটে? দিনেশের পথ? তার মানে, এখনই ঘাড় কুঁজো করে, রাত্রের শস্তা বাজার সেরে বাড়ি ফেরা, আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরের মধ্যে থুম্বো মেরে বসে থাকা! অফিসে বাবার বয়সীদের সঙ্গে মেয়েমানুষ নিয়ে আলোচনা! এমনি করে বয়স গড়াতে গড়াতে চিতায় গিয়ে উঠবে।
কিন্তু পরিণাম যে এমন হবেই তার কি ঠিক আছে! হয়তো এমন কোন সুযোগ আসতে পারে, যাতে আর যাই হোক মোটামুটি মানুষের মত দিন কাটান যায়। কিন্তু সুযোগের জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না, তাকে ফন্দি ফিকির ক’রে হাতাতে হয়। চিনু ভেবে খুশি হল, চাকরির যে কটা সুযোগ ছিল, তার প্রত্যেকটাই সে চেষ্টা করেছে। পায়নি, অথচ এখনই পাওয়াটা দরকার। দরকারের সঙ্গে সুযোগের সম্পর্কটা অদ্ভুত। কিছুতেই দুটো এক জায়গায় মেলে না। এক সময় মনে হয়েছিল কাবেরীকে দরকার, তার শরীরটাকে দরকার, অথচ কোন সুযোগ এল না। রমার বিয়ে একদিন দিতেই হবে। কিন্তু নিজের জন্য ওর কোন চেষ্টা নেই। সুযোগ কি কেউ কখনো তৈরি করে দেয়? ওটাকে তৈরি করে নিতে হয়। অথচ তাতে বাগড়া দেয় কতকগুলো সংস্কার। না হলে স্টেটবাসে কণ্ডাক্টারীর সুযোগ তো এসেছিল। তবু কিছু টাকা সংসারে দেওয়া যেত। সত্যিই এ সংস্কারগুলোকে চেষ্টা করে ধ্বংস করা উচিত। চিনু কথাটা দু’বার ভাবল অর্থাৎ সংস্কারের কথা। তারপরই মনে হ’ল সংস্কারটা শুধু তার একার। এই সংসারের সবকটা মানুষের মধ্যেই রয়ে গেছে। ওগুলো ভাঙা দরকার। না হলে সুযোগ এলেও তাকে ধরা যাবে না।
মাধবী তখন থেকে একইভাবে তাকিয়ে। কিছু একটা ভাবছে। গলা খাঁকারি দিয়ে চিনু বলল:
-দিনরাত ঘরের মধ্যেই থাকে, বাইরে বেরোতে-টেরোতে দাও না কেন? বন্ধুদের সঙ্গে না মিশলে কি চালাক হয়। তা ছাড়া বাইরে ঘুরলে পাঁচটা জিনিস দেখতে পাবে, বুদ্ধি পাকবে তাতে।
-বুদ্ধি পেকে হবে কি?
-নিজের ব্যবস্থা নিজেই তা হলে করে নিতে পারবে।
-নিজে তো যথেষ্ট বুদ্ধি পাকিয়েছিস, তবে রোজগার করতে পারিস না কেন?
এই মুহূর্তে মাধবী অসহ্য। উঠে পড়ল চিনু। আলনা থেকে সার্টটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। বিশ্ব তখন বাড়ি ফিরছিল। গলিতে চিনুর সঙ্গে দেখা। শুকনো হেসে ভদ্রতা করল চিনু।
-এখন ফিরছ?
-হ্যাঁ। গেছলুম এক জায়গায়। অনেকক্ষণ বসতে হল, তাই।
উঠোনের একধারে রোদ্দুরে পিঠ লাগিয়ে রমা কয়লার গুঁড়ো মাখছে। গুল তৈরি করবে। বিশ্ব সেদিকে মুখ ক’রে দাঁড়াল।
-চাকরির খোঁজে গেছলে তো?
বিশ্ব ঘাড় নাড়ল।
-ওরা ওই রকমের। একথা সেকথা বলে বসিয়ে রাখবে, কাজের কথাটি কিছুতেই পাড়তে দেবে না। দেখেছি তো।
-না না, ইনি লোক ভাল। বললেন তো চেষ্টা করবেন, সব মানুষ কি আর এক রকমের হয়?
চিনু হাসল। বেলা মাঝ-দুপুর। নিশ্চয় বিশ্ব এখনো ভাত খায়নি। তা সত্ত্বেও কি করে ওর মনটা এত উদার হল যে সব মানুষকেই ভালো ভাবতে পারছে? নাকি রমার উপস্থিতি ওকে খুশি করছে! তাই সম্ভব। এ বয়সটাই অমন। অমন বলতে কি বোঝায়? মানুষ সব থেকে ভালবাসে নিজেকে। তাই কি? তাহলে কি মানুষ অন্যকে ভালবাসতে পারে না? বিশ্ব কি রমাকে ভালবাসে? বাসুক, তাতে কিছু অন্যায় নেই। কিন্তু যদি ভালবাসে, তাহলে কেন বাসে। এটা কি শুধুই বয়সের জন্য?
চিনু রমার দিকে তাকাল। ভিজে চুলগুলো কানের পাশ দিয়ে কপালের ওপর এসে পড়েছে। মাথা দুলিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে দেবার সময় এদিকে তাকিয়ে হাসল। হাসিটা নিশ্চয় তার দাদাকে উদ্দেশ করে নয়। চিনু বিশ্বর দিকে তাকাল। রমার হাসিটা ওর মুখে লেগে ফেটে পড়ছে।
-যখন বলছ ভাল লোক, তখন দ্যা’খ চেষ্টা করে।
বার বার করে ফুঁ দিল চিনু। বিশ্বকে ঈর্ষা করার মত কিছুই নেই। অত্যন্ত সাধারণ, আর পাঁচটা ভদ্রলোকের মত জীবনটাকে কাটাতে পারবে। টিউশনী ক’রে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে। চেষ্টা করছে হয়তো একটা চাকরি পেয়ে যেতে পারে। তখন বিয়ে করবে। বিয়ে যদি করে, রমাকেই করুক না। কিন্তু কি এমন গুণ আছে রমার যে বিশ্ব ওকে ভালবাসবে? বিশ্ব শিক্ষিত, গ্র্যাজুয়েট। গ্র্যাজুয়েট হলেই যে শিক্ষিত হবে তার কোন মানে আছে? রামরতনবাবু তো সাধারণ নির্বাচনের সময় ভোট দিতে যান নি।