আর একজন মুরুব্বী পেয়েছিল সে। স্টেটবাসের কণ্ডাক্টারীর চাকরি ক’রে দেবে বলেছিল। চিনু রাজী হয়নি। বাসের ডিপোতে যদি কাজ পাওয়া যায় তাহলে সে রাজী ছিল। কেননা দেয়ালঘেরা ডিপোতে সে কি কাজ করছে চেনা পরিচিতের পক্ষে দেখে ফেলা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক বলে বিনিমাইনের এ্যাপ্রেণ্টিশ থাকার কথা। বিনিমাইনের খাটুনিতেও খরচ লাগে, কেননা খাটতে হবে মাইনে করা মিস্ত্রির সমান। আর শরীরের ক্ষয়পূরণের খরচা দেবার সামর্থ্য সংসারের নেই। টি-বিতে মরাকে চিনু ঘেন্না করে।
সংসারের কথা চিনু ভাবে। ভাবাটা বেশির ভাগই বুদ্ধি দিয়ে হয়। দেয়ালে সাঁটা সানুর ছবিগুলোর মত মনটা মাঝে মাঝে খাপছাড়া ভাবে বুদ্ধিকেও ছাপিয়ে ওঠে। বুদ্ধিরও একটা পরিসীমা আছে। যে কোন জিনিসের যা হোক গোছের একটা ব্যাখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু সংসারটা একটা জিনিস নয়। শুধু টাকা-পয়সা রোজগার, ভাল খাওয়া-পরা, হাসি-খুশির মানেই স্বচ্ছলতা নয়। প্রত্যেক মানুষেরই চিন্তা করার নিজস্ব ধরন আছে। তার আচার আচরণও সকলের থেকে কোনো না কোনো জায়গায় আলাদা। এই আলাদাগুলো যেমন মানুষের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলে তাকে অন্যান্যদের থেকে স্বতন্ত্র করছে, তেমনি এই স্বাতন্ত্র্যকে ঘুচিয়ে সকলের মধ্যে নিজেকে এক করে দেবারও অহরহ চেষ্টা চলেছে। না হ’লে মানুষ কেন ছবি দেখে বা গল্প উপন্যাস পড়ে, বা প্রেমে পড়ে? কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্য ঘোচাতে কি মানুষ পেরেছে? তাই কি কখনো সম্ভব? অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব। মাধবী যে চীৎকার করে, সেটা তার পক্ষে একান্ত দরকার। চীৎকার করে সে তার মনের ক্ষতির দিকটাকে পূরণ করছে। ভারসাম্য বজায় রাখছে। তা না রাখতে পারলে এতদিনে পাগল হয়ে যেত। চীৎকার করাটা দিনেশেরও দরকার। কিন্তু তারও নিজস্ব ধরন আছে চিন্তা করার। আবার রমার ধারণা, অন্যে ভেবেচিন্তে তার সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেইটাই মঙ্গলকর। অনেক রীতির চিন্তার সমষ্টি নিয়ে সংসারটা গড়ে উঠেছে। তাই চিনুর কাছে সংসারটা একটা জিনিস নয়।
ভিন্ন উপাদানে তৈরি অনেকগুলো জিনিস একজায়গায় থাকলে ঠোকাঠুকি হবেই। তবু মানিয়ে চলতে হয়। এই মানিয়ে চলার একটা ছাঁচ তৈরি হয়ে আছে অনেক কাল ধরে। কালের বদল আছে, ছাঁচেরও। এই ছাঁচ যারা তৈরি ক’রে নিজেদের কাজে লাগায়, তারা যদি কালের সঙ্গে সঙ্গে ছাঁচটাকেও না বদলায় তাহলেই ঠোকাঠুকি লাগে। ঠোকাঠুকিটা সংসারের এই মানুষে মানুষে আবার সংসারের সঙ্গে পরিবেশেরও। মানুষকে তাই সামলে চলতে হয়। সংসারের গণ্ডির বাইরে কি ওলট-পালট হচ্ছে মাধবীর পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু দিনেশ জানে। তাকে বাইরে বেরোতে হয়। তাকে পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে সংসারটাকে টিঁকিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বুদ্ধি দিয়ে চিনু বোঝে এ লড়াইয়ে তারও অংশ নেওয়া উচিত। কিন্তু উচিত বললেই আর পরিবেশ তা স্বীকার করে নেবে না। চিনু বুদ্ধির তাড়নায় চাকরি খুঁজেছে। চাকরি পায়নি, বুদ্ধি এই পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। মন তখন দেখেছে, দিনেশের ভেঙে-পড়া কাঁধ, তোবড়ান গাল, ঘোলাটে চোখ। চিনু লজ্জায় মুখ নামায় দিনেশকে দেখলেই। সে থাকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আবার, রমার ভীতু-ভীতু সরল চোখ দুটোও সে সহ্য করতে পারে না। মেয়েটা বড্ডো বোকা। উনিশ কুড়ি বয়সেও, এই বাড়িটার মধ্যে বেশ সুখেই আছে। ওর কামনা কতো স্বল্প। কি হবে ওর ভবিষ্যতে? ওকে দেখলে বিরক্তি আসে।
আর আছে সানু। চিনুর ধারণা, সানু আছে বলেই সংসারটা টাল সামলে টিঁকে আছে। ছোট বলেই সকলে ওকে আদর করে। ওর খেয়ালগুলোকে সহ্য ক’রে চলে। এইখানেই সানুর সার্থকতা। সংসারকে স্নেহ মমতা ক’রতে শেখায়। দুশ্চিন্তাকেও সহনীয় ক’রে তোলে। সানু সম্পর্কে ভাবনা সকলেরই কম, কেননা ওর কাছ থেকে এখুনি সংসার কিছু প্রত্যাশা করে না। আশা ক’রেও মানুষ অনেক জিনিসই পায় না। মনের কিছুটা অংশ খালি থাকে, ফলে মনটা যেমনভাবে থাকলে সুস্থ বলা যায়, তা আর থাকে না, একদিকে কাত হয়ে পড়ে। পৃথিবীর সব মানুষই যদি কাত হয়ে পড়ে তা’হলে সিধে বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু মানুষের স্বভাবই খাড়া থাকা। তাই মনের খালি অংশটাকে ভরাট করে গানের সুরে, কিংবা ছবির রঙে কিংবা অনেক কিছু দিয়ে। এ সংসারটাকেও সানু কাত হয়ে পড়তে দেয়নি।
সানুর মত এ সংসারে মাধবীর সার্থকতাও চিনু খুঁজে পেয়েছে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত, যেমনভাবেই হোক না কেন সংসারের একটা দিনকে আর একটা দিনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মাধবী যেন মজুর। একটা সংসারকে গেঁথে চলেছে সারা জীবন ধরে। গাঁথুনীর কোন ছক নেই। ওর উদ্দেশ্য শুধু সুখী হওয়া আর সংসারকে সুখী করা। অত্যন্ত মামুলি ইচ্ছে। পরিবেশ বদলেছে কিন্তু ছাঁচ বদলায়নি। ফলে বাইরের সঙ্গে ভেতরের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সংসারকে বাইরের সঙ্গে যুক্ত না করলে এ দ্বন্দ্ব ঘুচবে না। মাধবী তার সংসারের বাইরে কি ঘটছে, সে সম্পর্কে অন্ধ। ও শুধু মজুরের মত ভার বয়ে চলেছে। যুক্তিহীন যে কোন চেষ্টাই চিনুর কাছে নির্বুদ্ধিতার সামিল। তাই অসহ্যও। মাধবীকেও অসহ্য লাগে। যেমন এই মুহূর্তে তার লাগছে।
-রমার বিয়ে দেবে দাও, তা’তে আমি কি করবো?