আজকাল আর মাধবী চুপ করে থাকে না। কথার পিঠে কথা বলে, চেঁচায়, কেঁদে ওঠে। তখনকার নির্বিকার মাধবীকে দেখে ভয় হত। মনে অস্বস্তির যন্ত্রণা ধ’রত। নিজেকে ছোট মনে হ’ত। বাড়ি করা হয়নি, তার বদলে বাপ, দাদার সংসার থেকে আলাদা হয়ে ভাড়াবাড়িতে উঠতে হয়েছে। মাধবী তা’তেই খুশি হয়েছিল। হাসত, বায়না ধ’রত, আবার হিসেব ক’ষত খরচ কমাবার। সুখের দিন গেছে সেই সময়টা।
-ভাবছি, সেই দর্জিপাড়ার বাড়ির কথা। ও ঘরের আয়নাটা ওখানে উঠে গিয়েই কেনা হয়েছিল। এই খাটটাও।
হঠাৎ একথা বলল কেন দিনেশ! মাধবী অবাক হ’ল। সে তো কবেকার কথা! পুরনো কথা মনে পড়ে যখন মরণ ঘনিয়ে আসে। মাধবী তাকাল দিনেশের মুখে। চুলগুলো পাতলা হয়ে গেছে। মাথার বাদামী চামড়া দেখা যায়। চোখ দুটো ঘোলা ঘোলা। ঢেউয়ের মত গুটিয়ে এসে চোখের কোলে চামড়া জমেছে। বয়স হয়েছে দিনেশের। ও আর বেশিদিন বাঁচবে না। বুকের মধ্যে চিড়িক ধরল মাধবীর। ভয় করতে শুরু করেছে। দুনিয়ায় এই একটা মানুষ যার কথা সে ভাবে, আর যে তার কথা ভাবে। এই মানুষটাই থাকবে না। বুলাদের দেখে যমুনার জড়োসড়ো ভাব আর ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের বসাবার মধ্যে যে কাঙ্গালপনা ছিল, তাই দেখে জ্বলে উঠেছিল মাধবী। যমুনা যেন গোটা বাড়িটাকেই অপমান করেছে ওদের বেশি খাতির দেখিয়ে। অবস্থা ভাল হলে যমুনা নিশ্চয় তাকেও খাতির করত। আর তখনই মাধবী তার দুরবস্থার জন্য দিনেশকে দায়ী ক’রে অভিশাপ দিয়েছিল মনে মনে। অথচ তখন যদি সে বুঝত দিনেশের বয়স হয়েছে, সে আর বেশিদিন বাঁচবে না, তাহলে কি শাপমণ্যি করত!
-তোমার বালিশটা বড় পাতলা। অসুবিধে হয় না শুতে? মোটা বালিশ ছাড়া তো শুতে পারতে না!
খুশি হল দিনেশ। মাধবীর মনটা ভালো হয়ে আসছে। ভালোই হয়েছে ওকে সুখের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে। চারপাশের কষ্টের চাপে প্রাণ যখন হাঁপিয়ে ওঠে তখন পুরনো দিনের সুখকে সম্বল করা ছাড়া গতি কি! মনটাকে অনেক বছর হাঁটিয়ে পিছিয়ে নিতে হয়। অনেক কিছু দেখতে দেখতে যায়। পথের আনাচে কানাচে কত হীরে, মুক্তো পড়ে আছে!
-অসুবিধে হয় বৈকি। মাথা থেকে বালিশ সরে গেলে আগের মত যে আর কেউ বালিশ ঠিক ক’রে দেয় না।
স্নেহ চায়। জীবনের কামনা বাসনাগুলো মানুষ মেটাতে চায় যখন বুঝতে পারে আর সে বাঁচবে না। মাধবী হাত রাখল দিনেশের কাঁধে। যৌবনের দিনকে ফিরে চায়। অনেক দুঃখ কষ্ট পাওয়া মানুষের এই একটাই তো বেঁচে থাকার ভরসা। দিনেশ আঁকড়ে ধরল মাধবীর হাতটা।
-আমার বালিশ নিয়ে যে হঠাৎ দুর্ভাবনা হল?
-তোমারই বা হঠাৎ দর্জিপাড়ার বাড়ির কথা মনে এল কেন?
মাধবীর গালে হাত রাখল দিনেশ। চোখ বুজল মাধবী। সিরসির করে তার গোটা শরীর। বুলারা চলে যাবার পর বড়বৌকে জিগ্যেস করেছিল মেয়ে-পছন্দ সম্পর্কে ওরা কিছু বলেছে কিনা। মুখ কালো করে বিরক্তিতে জবাব দিয়েছিল বড়বৌ, কে জানে বাপু বড়লোকদের ঠ্যাকার-ঠোকর। পয়সার গুমোরেই ফুলছে। কথাগুলো শোনার পর, মাধবীর মনের অবস্থাটা এখনকার মত হয়েছিল।
গালে হঠাৎ চাপ দিল দিনেশ। কদিন থেকেই দাঁতটা নড়ছিল মাধবীর। মুখ বিকৃতি করে দিনেশের হাতটা সরিয়ে দিল।
-শুয়ে পড়ো। আর রাত করতে হবে না।
হুবহু সেই আগের মত কথা। দর্জিপাড়ার বাড়িতে মাধবী পাশ ফিরে অন্য দিকে মুখ করে কথাটা বলত। তখন তারা এক বিছানায় শু’ত। আলোর সুইচে হাত রেখে অপেক্ষা করছে মাধবী দিনেশের শুয়ে পড়ার।
-শোনো।
মাধবী কাছে এল। মাথা নামিয়ে দিনেশ আবার মাথা তুলল। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপরই মাধবীকে দু’হাতে জড়িয়ে কাছে টানল। টাল সামলে, জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে মাধবী আলো নিভিয়ে দিল।
-সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ন্যাকামি করা পোষায় না। তা’ছাড়া লাভই বা কি বুড়ো বয়সে এইসব ক’রে। এক পা তো বাড়িয়েছ ঘাটের দিকে।
মাধবী শু’তে গেল পাশের ঘরে। ভূতের মত দিনেশ বসে রইল।
.সারাদিন খাটাখাটুনির পর শোয়ামাত্রই রমা ঘুমিয়ে পড়ে। আজও ঘুম আসছে। কিন্তু জোর করে সে ঘুমকে ঠেকিয়ে রেখেছে। বেশ লাগছে নিজেকে বুলার বৌদি কল্পনা করতে, শান্ত, পরিপাটি ঘর। করার মত কোন কাজ নেই। নেই কে বললো, শাশুড়ীর পান সাজা, চা তৈরি করা, অফিসের জামা কাপড় ঠিক করে রাখা, টুকিটাকি কাজের কি অন্ত আছে। টুকিটাকি কি রকম! কেন, সকালে দাড়ি কামাবার যোগাড়-যন্তর, ভাজা মসলা তৈরি করা, খাওয়ার সময় কাছে বসা, বড়ি দেওয়া। বড়বৌ বুলাদের সম্পর্কে যা বলল রমা এখন মনে করতে চেষ্টা করল। লোকটা খুব শৌখিন। হয়তো বলবে, চলো সিনেমায় যাই। বুলার মত একটা ব্যাগ নিশ্চয় কিনে দেবে। বুলাকে না নিয়ে কি সিনেমা দেখা ঠিক হবে? কি মনে করবে তাহলে। প্রতিমার দাদা বিয়ের পর বৌকে নিয়ে একা সিনেমা গে’ছল। বোনকে সঙ্গে না নেওয়ার জন্য সবাই নিন্দে করেছিল। সব থেকে বেশি করেছিল আশা। তার ভাই অমন হলে নাকি বৌসুদ্ধ বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিত! আশাটা ভীষণ হিসকুটে। হবে না কেন, কোনদিন তো আরামের মুখ দেখেনি! কতো কষ্টেই ওর জীবন শেষ হবে। বিশ্ব কবে যে চাকরি পাবে তার ঠিক নেই।
সারাদিনে এই প্রথম বিশ্বকে মনে পড়ল রমার। আর তখনই যত রাজ্যের ঘুম এসে হুড়মুড়িয়ে ওর চোখের পাতা বন্ধ করে দিল।
তিন
এই মুহূর্তে চিনুর কাছে মাধবী অসহ্য। সেই এক কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসে। কিন্তু নিরুপায় সে। অফিসে অফিসে ধর্ণা দিলে চাকরি পাওয়া যায়। এ ধারণা, সিনেমায় দেখা শিক্ষিত বেকার নায়করা ছাড়া মেয়েমানুষেও করে না। মুরুব্বী না ধরলে এ বাজারে চাকরি পাওয়া সহজ নয়। আর মুরুব্বীদের অফিস পাড়ার বাইরেই পাকড়াও করা যায়। মাধবীই খুঁজে বার করেছিল তার দূর সম্পর্কের এক মামাতো ভাইকে। ব্যাঙ্কের সাতশো টাকার অফিসার। চাকরি দেবার ক্ষমতা রাখে। মাধবী বারবার বলেছিল মামাকে প্রণাম করতে। চিনু করেনি। অবশ্য মামা অতটা লক্ষ্যও করেননি, বলেছিলেন স্ট্রাইক মিটলে ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখা করতে। চিনু দেখা করেছিল। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, চেষ্টা করেও কাউকে ছাঁটাই করা যায়নি।