কিন্তু মাধবী কেন ধীরে সুস্থে কথাবলার ক্ষমতাটা হারালো? আজকালকার কথা শুনলে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চেঁচামেচি করলে তো চেঁচামেচি বন্ধ করা যায় না। তখন নিজের গলাটা টিপে ধরতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তাতেও সাহসের দরকার। আশ্চর্য, সে সাহসটুকুও নেই। নিজেকে নিজে খুন করার আগে ভাবনা চিন্তা করতে হয়। তাতেও যুক্তি দরকার হয়। মল্লিকবাড়ির বৌটা পুড়ে মরার আগে চিন্তা করেছিল। না হ’লে চিঠিতে কেন লিখল তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। স্বামীটাকে বাঁচিয়ে গেল। দিনেশকেও ভাবতে হয়, সে মরলে আর কেউ কি বাঁচবে? ছেলেমেয়েগুলো ভেসে যাবে। মাধবীকে ভিক্ষে ক’রতে হবে। তা ছাড়া মরলেই তো সব ফুরিয়ে গেল। এই শরীরটা, মনটা, জন্ম থেকে এই পর্যন্ত গড়ে ওঠা অভিজ্ঞতাটা। তার মধ্যে আছে মা’র আদর, বাবার শাসন, সতরো-আঠারো বছরের রোমাঞ্চ, বিয়ের প্রথম দু’টো বছর, চিনুর মুখে প্রথম কথা শোনা। আরো আছে-দুঃখ, বেদনা, ভয়। সব জড়িয়ে তিল তিল গড়ে উঠেছিল যে মানুষটা, তাকে এক নিমেষে শেষ করে দেওয়া কি সোজা ব্যাপার! ভাবতেও যন্ত্রণা হয়। অথচ বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণার। এর মাঝামাঝি আর কি করার আছে?
-গেছলুম মহিমের ওখানে। সব কথা বললুম, বললো খোঁজ পেলে জানাবে।
-কি জানাবে?
-রমার পাত্তর।
দিনেশ অবাক হ’ল, মাধবী যেন অন্য কিছু ভাবছে। হয়তো অন্য কথা বলতে এসেছে।
-গেছলে যখন, হাতটা দেখিয়ে এলে না কেন?
-কি হবে?
-কি আবার হবে, জানতে ইচ্ছে করে না ভবিষ্যতে কি ঘটবে? গ্রহ-চক্রের ফেরের কথা কিছু কি বলা যায়। জ্যোতিষীর কথা শুনে কানাই স্যাকরা তো বাড়ি হাঁকিয়েছে, লটারির টিকিট কিনে।
-জ্যোতিষীর পরামর্শেই কানাই লটারির টিকেট কিনেছিল একথা কে বললো? হতে পারে তখন ওর দুটো টাকা খরচ করার মত খোশ মেজাজ ছিল, কিংবা তখুনি শুনেছিল কোন লোকের লটারিতে টাকা পাওয়ার গল্প। তাছাড়া এও হতে পারে লটারির টিকিট বিক্রিওলার মুখ দেখে ওর দয়া হয়েছিল কিংবা ঝামেলা এড়াবার জন্য কিনে ফেলেছিল। জ্যোতিষীর গণনা যে অভ্রান্ত তার প্রমাণ কি লটারি জেতা দিয়ে বোঝা যায়?
-তাহলেও ভবিষ্যৎ জানতে তো ইচ্ছে করে।
-ওরা তো ভাল ছাড়া মন্দ বলবে না।
দিনেশকে হাসতে দেখে মাধবী অপ্রস্তুত স্বরে বলল,-ভাল শুনলেও তো মনে খানিকটা জোর পাওয়া যায়।
এমন কথা বিশ্বাস করে না দিনেশ। ভোটের আগে অনেকেই ভাল কথা বলেছিল। কিন্তু সেই ভাল ভাল কথাগুলো ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন দেশের মানুষ ভুলে গেছে। দেশে শিক্ষা বিস্তার কিংবা বেকার সমস্যার সমাধান নিয়ে দিনেশ মাথা ঘামায় নি। শুধু একটা ভরসা চেয়েছিল, চোখ বুজলে সংসারটা যেন ভেসে না যায়। কিংবা বুড়ো বয়সে অথর্ব হয়ে পড়লে না-খেয়ে মরতে না হয়। এইটুকুর জন্যই ভোট দিয়েছিল সে। কিন্তু আজও আশপাশের মানুষজনের হাবভাব কি, কথায় বার্তায় একমুহূর্তের জন্যও নিজেকে নিরাপদ মনে হয় না। মাধবীও বোঝে তার ভবিষ্যৎ নিরাপদ নয়। যদি না বুঝত তাহলে মাঝে মাঝে এমন করে ক্ষেপে ওঠে কেন? কিন্তু ওর ক্ষ্যাপামিটা ভুল লক্ষ্যের দিকে। নয়া পয়সা নিয়ে গোলমাল হলে যাত্রীরা যেমন ওপরওলাদের কাছে প্রতিকারের দাবী না জানিয়ে নিরীহ কণ্ডাক্টারদের মারধোর করে, এও তেমনি। আসলে মাধবী যুক্তি দিয়ে বিচার করে না। তাহলে তো সে বুঝতে পারত সংসারে এই দৈন্যদশার জন্য দিনেশের কোন হাত নেই।
-কথা বলছ না যে, কি ভাবছ?
চমকে উঠল দিনেশ। তাকাল মাধবীর দিকে। থুতনির নিচের মাংস কে যেন খুবলে নিয়েছে। চোয়ালের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কণ্ঠার হাড় দুটোর মাঝে গর্ত। চুল উঠে গিয়ে কপালটা বেখাপ্পা উঁচু দেখাচ্ছে। চোখদুটো ড্যাবড্যাবে। থ’ হয়ে তাকিয়ে রইল দিনেশ। এই মাধবীকে যদি ভালো ভালো কথা শোনান যায় তাহলে কোত্থেকে ও জোর পাবে? ওকে তো শুষে নিয়েছে। ভাল কথার রসে ওর শরীর কিংবা মনের স্বাস্থ্য ফিরবে না। শরীরের স্বাস্থ্যেই তো মনের স্বাস্থ্য।
অথচ এক সময় ছিল যখন টসটস করত মাধবী। ঝগড়া ক’রত, মুখ সরিয়ে নিত। সকালে নাকি মুখ দেখাতে পারে না। সারা গালে ছোপ ধরে থাকত জমে-ওঠা রক্তের। দিনেশ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এই কি সেই মানুষটা! টানাটানা, ভাসাভাসা চোখদুটোর কি হাল হয়েছে! তখন মাইনে কম ছিল, তবুও দাদা, বাবা বেঁচেছিল, তাই সংসারের আঁচ তেমন গায়ে লাগত না। হাঁড়ি এক হলেও, সাধ-আহ্লাদের খরচগুলো ছিল যে যার নিজের। দুটো মানুষের তাতে স্বচ্ছন্দে কুলিয়ে যেত। তারপর সন্তান জন্মাল। সাধ-আহ্লাদের খরচ কমাতে হ’ল। সংসারে ছোটখাট ঝগড়া দেখা দিল। ঝগড়া যাতে পাকাপাকি বন্ধ হয় তাই দিনেশই একদিন কথা তুলল নিজেদের ছোট্ট একটা আলাদা সংসারের। শোনামাত্র মাধবীর সেকি চনমনানি! যেন সত্যিসত্যিই তার আলাদা সংসার হয়েছে। জমির দাম তখন সস্তা ছিল। প্রত্যেকদিনই মাধবী তাড়া দিত। কিন্তু জমি কিনে বাড়ি তোলার টাকা কোথায়? মাধবী সেই প্রথম গুম খেয়ে যায়। তখন থেকেই সে অল্পে চটে উঠতে শুরু করে।
কিন্তু জমি দেখা বন্ধ করে নি দিনেশ। কেমন নেশার মত হয়ে গেছল ব্যাপারটা। খবর পেলেই ছুটে যেত। দর দাম করত। বাড়িতে এসে হিসেব করত। নির্বিকার হয়ে মাধবী শুনে যেত।