-তোমার নাম ঠিকানাটা একটু লিখে দাও তো মা।
রমা এই প্রথম বুলার মার চোখে চোখ রাখল। এতক্ষণ মাধবীর হাজা ঘা-পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে গা ঘিন ঘিন করছিল। বেশ টসটসে ফরসা গাল, অল্প লোম নাকের নিচে, কানে মুক্তোর ফুল, হাসিখুশি মুখটা। লেখবার যা কিছু সরঞ্জাম ওঘরে। সানু ছাড়া এ সংসারে আর কারুর বিশেষ দরকার হয় না লেখার। দিনেশের একটা কলম আছে, সেটা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। সে এখন অফিসে। সানুর কলম নেই, পেন্সিল আছে। সানু এখন স্কুলে। রমা মুখ শুকিয়ে তাকাল মাধবীর দিকে। কেমন থমথমে যেন মুখটা। আর দেরি না করে রমা উঠে পড়ল।
হাতের লেখা আর অঙ্কের জন্য কালি দরকার হয় সানুর। বড়ি গুলে স্নো’র শিশিতে কালি তৈরি করা আছে। শিশিটা রমা মধুসূদনবাবুর মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল। শিশির অবস্থা দেখেই বুক শুকিয়ে গেল রমার। সেটাও শুকনো। জল দিয়ে কালি তৈরী করে নিল। কলমের হাতলের মাথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। ওরা দেখলে কি মনে করবে। এখন ছুটে গিয়ে যমুনার কাছ থেকে ফাউণ্টেনপেন আনা যায়। তা হলে ওঘরের সামনে দিয়েই যেতে হবে। ওরা দেখতে পাবে। যা করা যাবে না তা নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই। সানুর একটা খাতা নিয়ে রমা ওঘরে গেল।
জল বেশি পড়েছিল। কালিটা এত পাতলা লেখা পড়া যায় না। বুলা ব্যাগ থেকে তার কলমটা বের করে দিল। শুধু নিজের নয়, বাবার নামটাও লিখতে হল। ইংরেজীতে রমা নিজের নামটা লিখতে পারল। শুধু লেখা কাগজটা পাট করে বুলা ব্যাগে রাখল।
এরপর আর বেশিক্ষণ থাকেনি ওরা। বড়বৌ ওদের নিয়ে গেল, অন্য ভাড়াটেদের দেখাবার জন্য। সঙ্গে মাধবীও গেল। দেখার জন্য রমা দরজার পাল্লাটা ফাঁক করে উঁকি দিল। উঠোনের এক কোণায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যমুনা, হাতে ছাই, পোড়া কড়াইটা প্রায় ঝকঝকে হয়ে এসেছে। হাত নেড়ে বড়বৌ বুলাদের কি যেন বলল। যমুনা হাসল। চটপট করে ধুয়ে ওদের নিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল।
বিকেলে ছাদে গেল না রমা। কড়িকাঠের কোণায় যে এতদিন ঝুল জমে উঠেছে, হঠাৎ এখন চোখে পড়ল তার। ছবিগুলো বেঁকে আছে মনে হল। দালানে কয়লা রাখার জায়গাটা যদি ইঁট দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায় তাহলে মন্দ দেখাবে না। বাজারের থলিটা অন্য কোথাও টাঙিয়ে রাখলে ভাল দেখাবে। গামছাগুলো আজকেই সেদ্দ করতে হবে। সংসারটাকে উলটে পালটে নতুন করে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছেটা আজই প্রথম মনে এল রমার। ইচ্ছে কখনো ফেলে রাখতে নেই। তাহলে কোনদিনই পূরণ হবে না। সারা বিকেল রমা ব্যস্ত রইল।
মাঝে মাঝে জ্বর ভাব হয় মাধবীর। তখন মেজাজটা বিগড়ে যায়। বিকেল থেকে তার শরীর খারাপ। আটা মাখতে গিয়ে বেশি জল দিয়ে ফেলেছে রমা। বরাদ্দের থেকে কিছুটা বেশি আটা মিশিয়ে সামলানোর চেষ্টা করায় মাধবীর মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ঘরে তখন দিনেশ বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। রমার হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে নিজের মনে গজগজ করে মাধবী।
-কি করে যে সংসার চালাই তার খবর তো কেউ রাখে না। ছেলেরা মানুষ হচ্ছে কি না, মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করা, সব এ মাগীকেই করতে হবে। আর উনি গায়ে ফুঁ দিয়ে বই পড়বেন।
জুতো পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিনেশ।
-যাচ্ছ কোন চুলোয়?
জবাব পেল না মাধবী।
-বলি, কথা বলতে পার না, মুখে কি কুড়িকুষ্ঠ হয়েছে?
-মহিমের কাছে যাচ্ছি।
দরজার খিল খুলল দিনেশ। ও যখন খোলে তখন শব্দ হয় না। সুর পালটে মাধবী বলল।
-ওকে ব’লোনা একটা ছেলে দেখে দিতে। কত তো দেখে গেল। শেষ পর্যন্ত শোনার জন্য দিনেশ দাঁড়িয়ে থাকে নি। প্রত্যেকটা কথা তার কানে গেছে। এমন কথা মাধবী রোজই বলে। আজ বিচ্ছিরি মনে হল রমার। সানু পড়ার নামে ঢুলছিল। সারাদিন বাইরে হুটোপাটি করে, সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসার সময়ই যত রাজ্যের ঘুম ওর চোখে নামে। রমার চড় পিঠে পড়তেই চমকে উঠল সানু। হতভম্ব ভাবটুকু কাটিয়ে লাথি ছুঁড়ল। লাগল না।
-মারলি কেন?
-মারব না? পড়াশুনো নেই, শুধু ঘুম! কালি নেই, কলম নেই, ইস্কুলের কি পড়া করিস? কালকেই দাদাকে খোঁজ নিতে পাঠাব।
কুঁকড়ে গেল সানু। যমুনাও বলাদের দেখে কুঁকড়ে গেছল। সানুরটা ভয়ে, কিন্তু যমুনারটা? রমা পায়ে পায়ে উনুনের কাছে এল। মাধবী রুটি বেলে রেখেছে, দেরী করলে জড়িয়ে যাবে। তখন বিচ্ছিরি সুরে চীৎকার উঠবে। আজকেই হঠাৎ চীৎকারটাকে কেন ভয় করছে? সানু কিংবা যমুনার মত মনটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। যমুনা লজ্জা পেয়েছিল। রমার মনেও কেমন যেন লজ্জা করছে।
সাবধানে পাট খুলে তাতানো চাটুতে রুটি রাখল রমা। খুন্তিতে ওলট পালট করল। মনের মধ্যেও কত কি জড়িয়ে রয়েছে। সেগুলোকে যদি আলাদা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা যায়! রুটিতে শুকনো ঘায়ের মত পোড়া দাগ ধরেছে। তাড়াতাড়ি চাটুটা রমা নামিয়ে রাখল। বেশি চিন্তাভাবনা করলে লোকসান বই লাভ নেই। সেঁকা রুটি উনুনে রাখল সে। টসটসে হয়ে ফুলে উঠল রুটিটা।
রাত করে বাড়ি ফিরল দিনেশ। খাওয়ার পর ঘুমের তোড়জোড় শুরু করছে, তখন মাধবী কাছে এল। দিনেশ জানে মাধবী এবার কি বলবে। খুব আস্তে আস্তে কথা শুরু করবে। তাই শুনে মনটা খুশি হয়ে উঠবে। দুটো-চারটে হাল্কা কথা হবে। এটাসেটা থেকে সংসারের কথা আসবে। ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে নালিশ উঠবে। খুঁটিনাটি অভাব আর পাওনাদারদের বলে যাওয়া কথাগুলো আবার শুনতে শুনতে অসহ্য বোধ হবে। আর তখনই সরু গলায় সুরটাকে চেপে গালাগাল দেবে অদৃষ্টকে। বিটকেল শোনায় তখন ওর স্বর। চীৎকার যে ধরনেরই হোক, আসলে ওটা নোংরামি। নোংরামিকে দিনেশ ভয় করে। ঝগড়াঝাটিগুলো আসে অভাব থেকে। অভাব শুধু খাওয়া-পরারই নয়, মানসিকও। রবীনকাকার অবস্থা ভাল। লেখাপড়া জানা সংসার। তবু ঝগড়া হয়। ওর ছেলে-বৌ আলাদা সংসার পাততে চায়, তাই নিয়ে ঝগড়া। কিন্তু এমন গলা চড়িয়ে ওরা কথা বলে না! ওই ধরনের কথা বলাকে মাধবী হয়তো বলবে তর্ক করা। তাই করুক না মাধবী। কিন্তু তর্কে, যুক্তির দরকার। মাধবী যুক্তির ধার ধারে না, বেশ কিছু তলিয়ে বুঝতে চায় না। শুধু আঘাত দিতে চায়, নোংরামি চায়। শুনতে কষ্ট হয়, এই কষ্ট বোঝার ক্ষমতাটাও মাধবীর লোপ পেয়েছে। অথচ সে আগে কত বোঝদার ছিল।