- বইয়ের নামঃ মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ১ম খণ্ড
- লেখকের নামঃ মতি নন্দী
- প্রকাশনাঃ দীপ প্রকাশন (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. ভূমিকা – বুদ্ধদেব গুহ
ভূমিকা
মতির লেখা এবং জীবনযাত্রার সঙ্গেও সমসাময়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের বিশেষ মিল ছিল না। সে ছিল বড়ো বাঘের মতো। তার জীবনযাত্রাতে তো বটেই জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও কোনো ভিক্ষা বা করুণাভিক্ষার লেশ মাত্র ছিল না। সে ছিল পুরোপুরি খেলোয়াড়-স্পোর্টসম্যান। ঈর্ষা, দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা কোনোদিনও দেখিনি ওর মধ্যে। ওর মৃত্যুর পরে অনেককেই দেখেছি ওর কাছের মানুষ হিসেবে দাবি করতে, কিন্তু বাস্তবে সেই অর্থে, ওর ভায়রাভাই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ছিল, তেমন অগণ্য স্তাবক ও পাঠকের দল নিয়ে তার দিন যাপন ছিল না। সে ছিল নির্জন এবং একাকী জীবনের পথিক।
শ্যামলের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র বিরূপতা নেই। ওর নামোল্লেখ করলাম নিছকই তুলনার জন্যে।
মতি লিখেছে অত্যন্তই কম, কিন্তু যতটুকু লিখেছে তা অতি উচ্চচমানের লেখা। প্রতিটি লেখাই স্বতন্ত্র এবং দিকদর্শক। প্রত্যেক লেখকেরই মতির লেখা পড়ে শেখার অনেক কিছু আছে। তরুণ লেখকদের তো বটেই, আমাদেরও। সাহিত্য যে নির্জন এককের গান হই-হুল্লোড়ের বিষয় নয়, তা মতি আমাদের প্রজন্মকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে।
ওর বইয়ের ভূমিকা লিখতে অনুরুদ্ধ হয়ে আমি গর্বিত বোধ করছি।
বুদ্ধদেব গুহ
নক্ষত্রের রাত
নক্ষত্রের রাত – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
ছোট ছোট তিনটে শব্দ করে দিনেশের কড়ানাড়ার অভ্যাস। রমা তখন শাড়ি বদলাবার জন্য আটপৌরেখানা আলনা থেকে নামাচ্ছিল, কিন্তু দিনেশের ফেরার শব্দ শুনে ঘরের দরজার আড়ালে এসে দাঁড়াল। চোখটুকু বার করে অপেক্ষা করতে লাগল কখন মাধবী দরজাটা খুলে দেবে। দরজা কে খুলবে তার কোন বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই, কাছে যে থাকে সেই খুলে দেয়। কিন্তু এখন রমার সাধ্যে কুলোল না ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। কে জানে কেমন খবর এনেছে দিনেশ।
দুটো লাগোয়া ঘরের সঙ্গে অন্ধকার-অন্ধকার দালানটার একদিকে রান্নাঘর, আর একদিকে দরজা। দরজাটা পলকা। কড়ানাড়ার সঙ্গে ওর কব্জাগুলোও কাঁপে। তখন বাড়তি আর একটা শব্দ হয়, কিন্তু দিনেশের কড়ানাড়ার মেজাজ এমনই যে বাড়তি শব্দটা আর হয় না। শুধু এইটুকু দিয়েই ওকে চিনে নেওয়া যায়।
কড়া দিনেশ নাড়ছে তাই ব্যস্ত হল না মাধবী। বিছানা থেকে টান দিয়ে পরিষ্কার সুজনিটা তুলে নিল। ছেঁড়া তোশক বেরিয়ে পড়ল। বালিখসা দেয়াল, বার্নিসচটা খাট, সিমেন্ট ফাটা মেঝে, নড়বড়ে একটা চেয়ার আর টেবিল, ঝাপসা গোটাকতক ছবি, এসবের মধ্যে পরিষ্কার সুজনিটা বেখাপ্পা দেখাচ্ছিল। মাননীয় বিদেশী অতিথিদের চোখ থেকে শহরের ময়লা এলাকা ঢাকবার আপ্রাণ চেষ্টারই একটা ছোট ধরনের উৎসাহ যেন এতক্ষণ ছিল। সুজনিটা তুলে নেওয়ায় ঘরটা স্বাভাবিক হল।
আর একবার কড়া নড়ল। নড়ুক। মাধবী ভাঁজ করতে শুরু করল সুজনিটা। পাশের ঘরে রমা আছে, খুলে দেবে। খাটের তলা থেকে ময়লা জামাকাপড়গুলো বার করে দড়ির আলনায় গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ তার মনে হল, দিনেশ যেন অন্যবারের তুলনায় শিগগির ফিরে এসেছে। এত তাড়াতাড়ি কি কথাবলা শেষ হয়ে গেল, না কথা না-বলেই শুধু রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল!
মাধবী দরজা খুলল। খিল খোলার শব্দে একবার শুধু কেঁপে উঠল রমা।
-কি বলল?
দিনেশকে ঢুকতে না দিয়ে, দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় মাধবী জিগ্যেস করল।
-বলেছিলে তো?
-হ্যাঁ। বলল পরে জানাবে।
কথাটা বলেই দিনেশ ঢুকতে চাইল। মাধবী নড়ল না।
-হাবভাব দেখে কি মনে হল, পছন্দ?
-কি জানি।
-দেনা পাওনার কথা বলল কিছু?
-না।
-তাহলে কি করলে এতক্ষণ!
মাধবী সরে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে দিনেশ ওর পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকল। যেন সব দোষটুকু তারই। মাধবী তাকিয়ে আছে। ঘেন্না করছে। তাকে অপদার্থ ভাবছে। মিষ্টি কথায় পাত্রপক্ষের মন ভেজাতে না পারলে, কাজ বাগাতে না পারলে তাকে অপদার্থ ভাবতে মাধবীর একটুও দ্বিধা হবে না। ও এমন ধরনের মেয়েমানুষ।
কাঁধের হাড়গোড়ের মাঝে দিনেশের মাথাটা যেন আর একটু বসে গেল। দিনে দিনে ক্রমশ সে ছোট হয়ে আসছে।
আটাশ বছর আগের বিয়ের ছবিটা এখনো দেয়ালে ঝুলছে। দিনেশের পরিষ্কার মনে আছে কোথায় তোলা হয়েছিল ছবিটা। বিয়ের পরদিন রওনা হবার আগে, মাধবীর বাপের বাড়ির পাশের বাড়ির উঠোনে জোড়ে ছবিটা তোলা হয়েছিল। ওর অনেকগুলো কপি মাধবীর বাবা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিলি করেছিল। কেউ কেউ নিজেদের ঘরে বাঁধিয়েও রেখেছিল। এখন, আটাশ বছর বয়সী কাচের ঐধার থেকে ছবিটা, যে কোন দম্পতির নামে খবরের কাগজে ছাপা যেতে পারে এত ঝাপসা!
মাঝে মাঝে দিনেশ ভাবত কাচটা পরিষ্কার করে দেবে। দেওয়া হয়নি। কেমন আলসেমিতে ধরে। এতে তার কি লাভ হবে। ছেলেমেয়েরা অবাক হবে শুধু, তাদের বাবার জোয়ান বয়সের চেহারা দেখে। রীতিমত সাঁতার-কাটা স্বাস্থ্য। এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না। না করলে কিছু লোকসান নেই। ছবিটার আজ কোন ধরনেরই মূল্য নেই। যে জিনিসের থাকা না-থাকা সমান, তার সম্পর্কে আলসেমি আসা স্বাভাবিক।
আজ কতদিন পরে ছবিটা যে ঘরে আছে, সে খেয়াল হল। চেয়ারে বসে দিনেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ছবিটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। ওটার কোন অর্থ নেই। এমন একটা অর্থহীন জিনিস যে এতদিন মাধবীর নজরে পড়েনি, এইটেই আশ্চর্যের। লাভ লোকসান না খতিয়ে তো মাধবী চলে না। যারা খতিয়ে চলে তারা বোধহয় এর মাঝামাঝিগুলোকে আমল দেয় না। আমাকেও ও আমল দেয় না। আমি লাভ লোকসান মেপে চলি না, চললে বোধহয় আরো চালাক চতুর হতে পারতুম; সংসারের এই হাল হত না। উৎসাহ থাকলে চালাক হওয়া যায়। মহিম আজ নিজের বাড়িতে অফিস করেছে, বাড়ির সামনে মোটরের ভিড় জমে। অথচ ও স্কুলে কি বোকাটাই না ছিল! স্কুল ছাড়লুম একসঙ্গেই প্রায়। আমি চাকরিতে ঢুকলুম, আর ও জ্যোতিষী মামার সাগরেদি শুরু করল। মহিমের সবকিছুতেই উৎসাহ ছিল। আজও আছে। আজও আগের মত ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলে, সাংসারিক পরামর্শ দেয়, আর সে পরামর্শ শুনলে লাভ ছাড়া লোকসান যে হবে না, তাই বোঝাতে নিজের দিকে আঙুল দেখায়। গল্পের মত শুনতে লাগে। নতুন টাকা আর আংটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতেও বেশ লাগে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাইরে এসেই ভুলে যাই। কি হবে মনে রেখে। টাকা করার পথ বড় নোংরা। তার থেকে অনেক ভাল চুপচাপ যেমন আছি তেমনি থাকা।