বিদ্যুৎ-প্রবাহ মেঘপুঞ্জের মতো গ্রীক সৈন্য সম্মুখে ছুটতে লাগলো।
এগামেমনন বড় আজাককে বললেন–ভাই, তোমাকে আমার কিছু বলতে হবে না, এদিকের সকল ভার তোমার উপর রইল আমি অন্যদিকে চলোম।
বৃদ্ধ বীর নেস্তরকে যেয়ে বললেন, বার্ধক্য আপনাকে দুর্বল করে দিয়েছে, নইলে গ্রিক যোদ্ধাদের মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠ। নেস্তর হেসে বললেন–যুবক বয়সের শক্তি আর নেই, তাই বলে ভয় করবেন না; আমি একা যা করতে পারি, সহস্র গ্রিক যুবকও তা করতে পারবে না।
এগামেমনন সন্তুষ্ট হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হলেন। ওদেসিজ বসে বসে গল্প করলেন, যুদ্ধের কথা কিছু ঠিক পান না। সন্ধি যে ভেঙ্গে গিয়েছে, তাও তিনি জানেন না। এগামেমনন কঠিন ভাষায় ওদেসিজকে লক্ষ্য করে বললেন–কাপুরুষ! সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, আর তুমি বসে বসে গল্প করছে।
ওদেসিজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন–এগামেমনন, তেলিমেকাসের বাপ ওদেসিজকে কাপুরুষ বলেছো? তুমি আমাকে এত ছোট মনে করো?
এগামেমনন লজ্জিত হয়ে বললেন–কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলেছি, মাপ কর।
বৈশাখের ঝড়ের মতো গ্রিক-সৈন্য ত্রয় সৈন্যশ্রেণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সমুদ্র তরঙ্গ শত বিভঙ্গে যেমন করে গর্জে ওঠে, গ্রিক সৈন্যরাও তেমন করে গর্জে উঠতে লাগলো। মার মার, কাট কাট করে শত্রু-সৈন্যরা আক্রমণ করলে তলোয়ারে তলোয়ারে, গদায় গদায়, বর্শায় বর্শায় ঝনঝন ঝন শব্দ শুরু হল। ত্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তস্রোত বইতে লাগলো। দিন। ভর যুদ্ধ চললো। ত্রয়বাসীরা কিছুতেই পারছে না। এগামেমনন, ওদেসিজ, আজাক, নেস্তর প্রভৃতি যোদ্ধার ভীষণ তলোয়ারের সামনে ত্রয় বীরগণ কেবল হটে যেতে লাগলো।
উপায়হীন হয়ে হেক্তর দ্রুত বেগে পথে ধাবিত হলেন। সারা শহরের নারী ও বুড়োদেরকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন-হে ত্রয়বাসীগণ, তোমরা একস্থানে জমা হয়ে আল্লা আল্লা করো, নইলে রক্ষা নেই। শত্রুর ভীষণ আক্রমণের সামনে সৈন্যেরা কিছুতেই টিকতে পারছে না। তার পর দ্রুতবেগে হেক্তর একবার তার পত্নী ও শিশু পুত্রকে দেখতে গেলেন। পত্নী শিশুকে কোলে করে উঁচু মাচার উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখেছিলেন। স্বামীকে আসতে দেখেই তিনি নেমে এলেন। তার পর স্বামীর বাহু ধরে বললেন–প্রিয় স্বামী, তোমার এই শিশুর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ। যে যুদ্ধ বেধেছে তাতে তুমি কিছুতেই বাঁচবে না, এই যুদ্ধই তোমার মুত্যুর কারণ হবে। প্রিয়তম, তুমি ছাড়া আর আমার কেউ নেই। তোমাকে হারিয়ে আমি কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবো না। আমার যারা আপন ছিল, তারা সকলেই থেবসের যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এ জগতে শুধু তুমিই আমার আছ, তবে। কি বলে আমাকে অনাথিনী করে যাচ্ছ? আমি যে তোমার বিবাহিতা পত্নী। আমাকে কার। হাতে দিয়ে যাচ্ছ? এই শিশু কাকে বাপ বলে ডাকবে?
হের অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন–প্রিয়তম, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু বল দেখি, দশজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে কেমন করে পালিয়ে থাকি? তোমার স্বামী যে কাপুরুষ নয়। অস্ত্র নিয়ে খেলা করতেই তার আনন্দ।
শিশুকে আদর করবার জন্যে হেত্তর হাত বাড়ালেন–শিশু অস্ত্রসজ্জিত পিতার মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে কাছে এলো না। হের একটু হাসলেন!
হের বললেন–প্রিয়তমে, তুমি যে বীর স্ত্রী। তোমার কি এ দুর্বলতা সাজে?
হেকতর-পত্নী আন্দ্রমেকি বললেন–না পতি! দুর্বলতা আমার সাজে না। যাও, যুদ্ধ করতে যাও, তবে এ বেদনা যে সহ্য করতে পারি নে।
হেকতর বললেন–আমাদের এই যুদ্ধ ধর্মের নয়। পেরিস মেনেলাসের পত্নীকে চুরি করে এনেছে, তা তুমি জান। ত্রয়ের প্রত্যেক বীরের পতন হবে, এ নগর ধ্বংস হবে, রাজপ্রাসাদ ধুলোয় মিশবে–এ আমি বলে রাখছি! রাজপরিবারের প্রত্যেকের কঠিন শাস্তি হবে। যে দিন বিজয়ী গ্রিক-সৈন্য ত্রয় নগর ধ্বংস করে পরাজিত শত্রুদের স্ত্রী-কন্যা ধরে নিয়ে যাবে, সে দিনের কথা মনে হচ্ছে। বীর হেকতরের রাজকুল-সেবিকা পত্নীকে একদিন গ্রিকেরা দাসীরূপে বিক্রয় করবে। কোথায় থাকবে তোমার শিশু আর কোথায় থাকবো
আমি। কোনো দূর দেশে কার বাড়িতে তুমি পানি তুলবে, এ দৃশ্য মনে উঠলেও যে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।
হেক্তর-পত্নী বললেন–স্বামী, ত্রয়নারীরা কি এতই দুর্বলা? তারা নারীরূপে স্বামী সেবা করে, প্রয়োজন হলে অসি ধরে যুদ্ধ করতেও জানে। তারা যেমন কটাক্ষ হানতে পারে, তীর নিক্ষেপ করতেও তারা তেমনি অভ্যস্তা। আমাদের জন্যে ভেবো না। বীরপত্নী জানে, সম্মান রক্ষার জন্যে কী করতে হয়। অসম্মান অপেক্ষা মৃত্যুই সে ভালবাসে।
শিশু ও পত্নীর মুখে চুম্বন দিয়ে হেক্তর বললেন–তবে বিদায় দাও।
পত্নী হেরের স্কন্ধে মাথা রেখে অতিকষ্টে বললেন–যাও স্বামী যাও। খোদার হাতে তোমাকে সমর্পণ করলাম।
হেক্তর ঘোড়া ছুটিয়ে পেরিসের ঘরের দিকে এলেন। ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন–পেরিস, পেরিস, এ কি হেলেনকে নিয়ে আলাপ করবার সময়? সারা দেশের পুরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিচ্ছে, আর তুমি এখানে রমণীর সঙ্গে প্রেম করছ! হায়, কেন তোমার ন্যায় নরাধমকে খোদা আমাদের ভাই করে পাঠিয়েছিলেন? ভিতর বাড়ি হতে বের হও।
পেরিস লজ্জিত হয়ে বাড়ির বের হয়ে এলো। তার হাতের তলোয়ার সূর্যরশ্মিপাতে ঝিকমিক করছিলো।