এগামেমনন যুদ্ধের জন্যে স্থান প্রস্তুত করলেন। হেকতর পেরিসকে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত করে দিলেন। এদিকে গ্রিকেরা মেনেলাসকে নানাবিধ অস্ত্র দিয়ে মনের মতো করে সাজালেন।
তারপর মেনেলাস ও পেরিসে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হল। পুত্রের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে হবে, এই ভয়ে রাজা প্রিয়াম যুদ্ধক্ষেত্র হতে বাড়ি ফিরে গেলেন। মেনেলাস তার ভীষণ তরবারি তুলে পেরিসকে এরূপ মুহুর্মুহু আঘাত করতে লাগলেন যে, শেষে পেরিস কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়ন করলেন। মেনেলাস তাকে ধরবার জন্যে, জনতার মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন–কিন্তু পেরিসের আর কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না। আসল কথা, পেরিসের সেই বন্ধু পরী, যে ইদা পাহাড়ে সুন্দরী বৌ দিতে চেয়েছিল, সে তাকে মেঘে ডেকে একেবারে বাড়িতে রানী হেলেনের কামরায় এনে তুলে দিল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘পেরিস গেল’ বলে চীকার হচ্ছিল, পেরিস তখন হেলেনের কাঁধে মাথা রেখে তাঁর ভয়ে-ভীত অন্তরে শক্তি-সান্ত্বনা খুঁজছিল।
ত্রয়বাসীরা পেরিসকে রক্ষা করবার জন্যে কিছুমাত্র লালায়িত ছিল না। এই হতভাগ্য রাজপুত্রের পাপের জন্যে যে তারা ধ্বংসের পথে ছুটেছে!
এগামেমনন উচ্চকণ্ঠে বললেন–হে সমবেত জনমণ্ডলী, যুদ্ধে কে জিতেছে তা তো দেখতে পেলেন। হেলেন এখন কাঁদের প্রাপ্য, তার বিচার করুন? যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, আর হেলেনকে আমরা চাই।
০৫. সন্ধি অনুসারে যুদ্ধ মিটমাট
সন্ধি অনুসারে এখানেই যুদ্ধ মিটমাট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সহসা একটা দুষ্ট ত্রয়বাসীর মনে হল যদি কোনো রকমে মেনেলাসকে মেরে ফেলতে পারতাম, তা হলে ভারি নাম হতো। পেরিস আমাকে বহু টাকা-কড়ি, ধনদৌলত দিত। এখন তো সন্ধি হয়েছে, এই সন্ধি-শান্তির মধ্যে শত্রুকে যদি জব্দ করতে পারি তাহলে তো সুবিধা।
এই কল্পনা মনে হতেই, তাঁর মনে পাপ বাসনা উদয় হল। আরও কয়েকজন সঙ্গীকে সে এইকথা বললে। তারা এই কু-কাজ থেকে তাকে নিরস্ত করবে কি, আরও উৎসাহ দিলে।
দীর্ঘ ধনুকটি খাড়া করে সে তাতে একটা তীক্ষ্ণধার তীর বসালে; কিন্তু কয়েকজন ছাড়া কেউ বুঝতে পারলে না, কি অভিসন্ধি তার মনে রয়েছে। যাই হোক, ধীরে ধীরে সে গ্রিক সৈন্যনিবাসের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো–তার দুষ্ট কাজের বন্ধুরাও তাঁকে ঘেরাও করে সম্মুখের দিকে চল্লো, কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে।
গ্রিকদের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ ছিল না। হঠাৎ একটা তীর এসে মেনেলাসের স্কন্ধ ভেদ করে গেল, শরীর হতে রক্তধারা বের হতে লাগলো। এগামেমনন ক্ষিপ্রগতিতে মেনেলাসকে কোলে তুলে নিলেন। গ্রিকেরা অসর্তক ছিলেন বলেই এই দুর্ঘটনা হয়েছে–এত সহজে বীর মেনেলাসকে আঘাত করে এমন সাধ্য অতি অল্পলোকেরই ছিল।
এগামেমনন মেনেলাসের যত্ন করতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন হতভাগ্য জাহান্নামী ত্রয়বাসী, যে অধর্ম তোমাদের রাজপুত্র করেছে তার তুলনা নেই; তোমরা যে এত বড় হীন তা স্বপ্নেও ভাবি নি। সন্ধির বাহানায় আজ আবার এ কী কাজ করলে? ঠিক জেনো এর প্রতিফল পাবেই। তোমরা এত বড় শঠ, তা জানতাম না। ভেবেছিলাম, রাজপুত্রের কুকর্মের সঙ্গে তোমাদের কোনো যোগ নেই, অনিচ্ছায় যুদ্ধ করতে এসেছে–সে ধারণা আমার ভুল। যাক, আর না-হয় গ্রিকেরা এই সমুদ্রকূলে ধ্বংস হবে, নতুবা ত্রয় নগরকে চূর্ণ করে, পেরিসকে জীবন্ত জ্বালিয়ে তারা হেলেনকে উদ্ধার করবে।
তার পর মেনেলেসকে লক্ষ্য করে বল্লেন–বন্ধু মেনেলাস, জীবনের এই অসময়ে তোমাকে হারাবার জন্যেই কি এখানে এসেছিলাম? তোমাকে ছেড়ে কী করে দেশে ফিরবো, আর তো সহ্য হচ্ছে না; হে মাটি, তুমি দু’ভাগ হয়ে যাও–তোমার গর্ভে প্রবেশ করে এ শোক আমি জুড়াই।
মেনেলাস সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ভাই এগামেমনন, অধীর হইও না, আঘাত তত গুরুতর হয় নি। চিকিৎসককে ডাক, খোদার মরজি শীঘ্রই ভালো হবো, জন্মভূমির গৌরব রক্ষার্থে আবার তোমার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবো। হা হতভাগী হেলেন–এই কথা বলে মেনেলাস অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
চিকিৎসক তাঁর ঔষধ নিয়ে এলেন। নির্মল শীতল পানিতে ক্ষতটা ধুয়ে ঔষধ লাগাতেই মেনেলাস অনেকটা আরাম বোধ করলেন। ক্ষতমুখে রক্ত বন্ধ হয়ে গেল।
এগামেমনন বন্ধু মেনেলাসকে জাহাজে পাঠিয়ে সমবেত সৈন্য শ্ৰেণীকে উচ্চকণ্ঠে বললেন, তোমরা বুঝতে পেরেছ, ন্যায়ধর্মের প্রতি তাদের কোনো মন নেই। তাদের কুমতলবের অন্ত নেই। বৃথা তোক ক্ষয়ে বিশেষ লাভ কি ভেবে আমি সন্ধিপ্রার্থী হয়েছিলাম–ত্রয়বাসীরা তার প্রতিদান কী দিয়েছে, তা তোমরা স্বচক্ষে দেখলে। ত্রয় নগরের একটি প্রাণী যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, যতক্ষণ না তাদের পাপের চরম শাস্তি দিয়ে হেলেনকে উদ্ধার করতে পারি, ততক্ষণ আমরা ত্রয় ত্যাগ করবো না। যদি এখানে কোরবানি হয়ে যেতে হয় সেও ভালো তবুও অন্যায়কে জয়যুক্ত দেখে আমরা ফিরে যাবো না। পাপ দমন করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম–কুকুরের ন্যায় হীন হয়ে এ জগতে বেঁচে থাকতে গ্রিসের কোনো মানুষ যেন না চায়।
সৈন্যগণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
অতঃপর সেখানে দুই মহাবীর ছোট ও বড় আজাক দাঁড়িয়ে ছিলেন, এগমেমনন সেখানে উপস্থিত হলেন। বীরত্ব গৌরবে তেলামনের ছেলে বড় আজাকের স্থান এচিলীসও ওদেসিজ এর নিচেই।