এগামেমনন বললেন–স্বার্থপর এচিলীস, নিজে এক সুন্দরী রমণী লাভ করেছ–অপর কেউ কিছু পাক না পাক, সেদিকে তোমার কিছুমাত্র দৃষ্টি নেই। মানুষ এতই অন্ধ!
এচিলীস বললেন–এগামেমনন তোমার পাপে জাতির মাথা নত হবে। রমণী লাভ করবার জন্যেই কি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছ?
এগামেমনন তোমার ঐ সব রঙ্গিন কথা ফেলে রাখ। বেশ, তোমার ব্রীসাসকে আমায় দিয়ে দাও, নইলে আমি আমার বিজিতা কুমারীকে কিছুতেই ছাড়ব না। যে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে, তার রক্তে এই তরবারি লাল করবো, এই আমার কথা।
এচিলীস বললেন–অকৃতজ্ঞ এগামেমনন, কাঁদের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছি? আমার কি ক্ষতি হয়েছিল? আমার সঙ্গে এই দুর্ব্যবহার! তোমারি বোনকে পেরিস চুরি করে এনেছে, তাতে আমার কী? আমি দেখে আসছি, যত কষ্টের কাজ আমাকেই করতে হয়, অথচ ভোগের বেলায় তোমরাই বড় ভাগ নেবার জন্যে এগিয়ে আস! তাতেও আমার দুঃখ ছিল না, কিন্তু তোমার এ অপমান আমার সহ্য হচ্ছে না। থাক, আমি আর দুঃখ করতে চাই নে, তোমরা থাক, আমি দেশে যাই।
নিতান্ত ধৃষ্টের মতো এগামেমনন বললেন, তা বেশ–যাও তুমি চলে, তোমায় দিয়ে আমাদের কোনো দরকার নেই। কে তোমাকে আসতে বলেছিল? গায়ে শক্তি আছে বলে, তোমার এত অহঙ্কার? তুমি যদি আমায় না মানো তাতে আমার বিশেষ আসবে–যাবে না–এখানে বহু বীর আছে, যারা আমার সম্মান বোঝে। কে তোমার শরীরে অসীম শক্তি দিয়েছে? খোদা দিয়েছেন বলেই এত বড় হয়েছ,তার জন্যে এত অহঙ্কার কেন? তোমার জাহাজ, তোমার লোক-লস্কর নিয়ে এই মুহূর্তে ত্রয়ভূমি ত্যাগ কর–আমি আমার কুমারীকে। ফিরিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু ঠিক জেনো, ব্রীসাসকে নিয়ে তুমি কিছুতেই জাহাজে চড়তে পারবে না।
এচিলীস এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না, কম্পিত বাহুতে দীর্ঘ তলোয়ার কোষ মুক্ত করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখতে পেলেন–মহাশূন্যে পরী কুমারী এনিথী তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলছেন–থাম এচিলীস, বীরধর্মের অবমাননা করো না। নিজেদের মধ্যে কলহ, বিবাদ করে জাতির অসম্মান বাড়াচ্ছো? গ্রিসের প্রতি কত বড় অন্যায় হয়েছে, এর প্রতিশোধ নেবে না? পেরিসের পাপের যদি শাস্তি না দাও, তা হলে তোমার তরবারি ধারণ বৃথা। পরীবালা হেরা তোমাকে ভালবাসে, তারি আদেশে তোমার কাছে এসেছি। দেখ, জীবনে মহৎ হতে অনেক বেদনা সহ্য করতে হয়, ক্রোধে তোমার মহত্ত্বকে খাটো করে ফেলো না। এও তোমার বলে রাখছি, শীঘ্রই সময় আসবে যখন এগামেমননকে এই দুর্ব্যবহারের জন্য অনুশোচনা করতে হবে।
এচিলীস তলোয়ার ছেড়ে দিয়ে বললেন–পরীরা চিরকালই মানুষের মঙ্গল কামনা করে–হে পুণ্যের ছবি, তোমার আদেশ আমি পালন করলাম।
এচিলীস অতঃপর এগামেমননকে বললেন–কাপুরুষ, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে জাতির সর্বনাশ করতে চাই নে। বীর নামের কলঙ্ক তুমি; তোমার প্রজারা কাপুরুষ, তাদের রাজা তুমি, তাই এই স্বার্থান্ধ স্বভাব তোমার। আমি আজ আল্লাহকে সাক্ষী করে বললাম, আমাকে যে আপমান করেছ, তার ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ ব্রীসাসকে তোমরাই আমাকে দিয়েছিলে–ফিরিয়ে যদি নিতে চাও, নাও আমার তাতে আপত্তি নেই।
তারপর সভা ভেঙ্গে গেল। এগামেমনন সাধুর মেয়েকে বাড়ি যেতে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রিকদের মধ্যে আবার শান্তি ফিরে এল–সে ভীষণ ব্যাধি হতে তাঁরা রক্ষা পেলেন।
এচিলীস ব্রীসাসকে পরিত্যাগ করলেন। গভীর শোকে এচিলীসের হদয় চূর্ণ হয়ে গেল। দুঃখ যখন বেশি লাগতো, চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন না, তখন সাগর কূলে যেয়ে বসতেন, দূর সমুদ্রসীমার পানে চেয়ে থাকতেন।
০৪. মন পরীক্ষা করবার জন্যে
মন পরীক্ষা করবার জন্যে একদিন এগামেমনন সৈন্যদেরকে ডেকে বললেন–চল, আমরা দেশে যাই; কেন আর মিছামিছি পরের জন্য লড়াই করে মরি!
সৈন্যেরা আনন্দিত হয়ে বললে–তাই তো! কেন আমাদের এই মাথা ব্যথা? কেন জন্মভূমি ত্যাগ করে সাগরপারে হেলেনের জন্যে প্রাণ দিতে এসেছি? সে শয়তানী গোল্লায় গিয়েছে, তাতে আমাদের কী? এই কথা বলে মহাউল্লাসে তারা জিনিসপত্র ও তাঁবু বেঁধে জাহাজে ওঠা শুরু করলো।
আসলে হেলেনকে রেখে যে গ্রিক বীরেরা দেশে চলে যাবেন, তা তো হতে পারে না, এগামেমননের ইচ্ছে–একবার সকলের মন পরীক্ষা করেন।
অনেক কষ্টে ওদেসিজ সৈন্যদেরকে জাহাজ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। ওদেসিজ বললেন, হে গ্রিসের বীরগণ, তোমরা যে কাপুরুষের মতো দেশে ফিরে যাচ্ছো–দেশের লোকেরা যখন জিজ্ঞাসা করবে, কী করে এলে? তখন কী বলবে? নারীরা যখন জিজ্ঞাসা করবে–হেলেন কই, তখনই বা কী বলবে? রিক্তহস্তে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার জন্য কি তোমরা আস্ফালন করে ত্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিলে? অসম্মানে বেঁচে থাকা অপেক্ষা মরণই যে শ্রেয়, তা কি তোমাদের মা তোমাদেরকে শেখান নি? প্রতিজ্ঞা কর, হে গ্রিসের সন্তানগণ, যাবৎ না আমরা হেলেনকে উদ্ধার করতে পারি, ঐ ত্রয় নগর যতদিন না আমাদের হয়, ততদিন এখান হতে ফিরে যাবো না। হেলেনের বিয়ের সময় বৃদ্ধ রাজা তানীরজের কাছে তোমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তা কী তোমাদের স্মরণ নেই?
সৈন্যেরা করতালি দিয়ে বললে, গ্রিকজাতি কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয় নি, কোনো দিন তারা কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নি। এই বিশাল নগর আমরা জয় করবোই করবো, গ্রিসের জয়পতাকা এখানে উড়াবো।