একবার হাত দিয়ে নেড়ে দেখলেন–বর্শার মাথা ঠিক আছে কি না। দেখলেন, ঠিক আছে তবে এমন হচ্ছে কেন?
কাছেই আর একটা পাহাড়ের মতো লোক দাঁড়িয়েছিল–অস্ত্রের ফলা পরীক্ষা করবার জন্যে, সাইনাসকে রেখে এচিলীস তাকে আক্রমণ করলেন–এক আঘাতেই বেচারা দুই খণ্ড হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
এচিলীস দেখলেন–অস্ত্রের ধার তো কমে নি। এবার দারুণ ক্রোধে তলোয়ার দিয়ে শক্রকে পুনরায় আঘাত করলেন। সাইনাসও চুপ করে বসে ছিল না। সেও গদা দিয়ে এচিলীসকে আক্রমণ করছিল। সে ভীষণ আক্রমণ সহ্য করা এচিলীসের পক্ষে কঠিন হচ্ছিল।
ঘৃণা ও ক্রোধে এচিলীসের সর্ব শরীর কাঁপছিলো। একবার আল্লার নাম ধরে এচিলীস মৃদু স্বরে প্রার্থনা করলেন–হে খোদা, অন্যায়কে হত্যা করার জন্যে যুদ্ধে এসেছি, আমার বাহুতে বল দাও।
কে যেন তাঁর কানের কাছ বলে গেল–ভয় নেই। এচিলীস বুকের ভিতর নূতন করে শক্তি অনুভব করলেন–সাইনাসের দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন–দুর্বত্ত, এইবার আমার আঘাত সহ্য কর। এই কথা বলতে বলতে সাইনাসের কাঁধের উপর তিনি এরূপ পুনঃ পুনঃ আঘাত করতে লাগলেন যে সাইনাসের লোহার কোট কেটে গেল। এচিলীসের তলোয়ার সাইনাসের পার্শ্ব ভেদ করে গেল, সাইনাস বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
সাইনাসের পতন দেখে ত্রয়-বাসীদের মনে ভয়ানক আতঙ্কের সঞ্চার হল।
যেদিক হেক্টর ও প্রিয়াম রাজার ছোট ছেলে যুদ্ধ করছিল, বর্শা তুলে সেই দিকে এচিলীস দ্রুতবেগে ধাবিত হলেন। এচিলীসের ভীম চেহারা দেখে ভয়ে সে কাঁপতে লাগলো,–কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এলে ভয়ে কাঁপলে তো যমে ছাড়বে না! এচিলীসের কোনো কিছু বলবার আগে সে তার তলোয়ারখানা তুলে একবার এচিলীসকে আঘাত করতে চেষ্টা করলে, কিন্তু অবশ হাত তার নিচে নেমে এল। এচিলীস হাতের তলোয়ার তুলতেই, সে ঘাড় ফিরিয়ে দে ছুট!
এচিলীসের বীরত্ব দেখে ত্রয়-বাসীরা বুঝতে পারলে এমন করে সামনাসামনি যুদ্ধ করলে কিছুতেই তাদের জেতবার উপায় নেই–তারা স্থির করে, শহরের ভিতর প্রাচীরের আড়ালে থেকেই যুদ্ধ করবে।
এদিকে গ্রিকরাও বুঝলেন এ যুদ্ধ সহজে মেটবার নয়। তাঁরাও ঠিক-ঠাক হয়ে বসলেন। শিবিরের চতুর্দিকে একটা প্রকাণ্ড গড় কাটা হল–যাতে শত্রুরা তাহাদের হঠাৎ আক্রমণ করতে না পারে।
ইতোমধ্যে এচিলীস এক নূতন রাজ্য জয় করে ফেললেন, কিছুদিন বাদে আর একটা রাজত্ব জয় করতে গিয়ে তিনি এক পরমা সুন্দরী কুমারী লাভ করলেন। মেয়েটির নাম ব্রীসাস। ব্রীসাসকে শেষে এচিলীস বিয়ে করলেন।
বীরবর এগামেমনন এচিলীসের সৌভাগ্য দেখে মনে মনে ভারি ঈর্ষান্বিত হলেন। তিনিও এক নূতন দেশ জয় করবার আয়োজন করলেন। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। ব্রীসাসের মতো এক সুন্দরী কন্যা লাভের আশায় তিনি সে দেশের এক সাধু ব্যক্তির কন্যাকে জোর করে হরণ করে নিয়ে এলেন।
কন্যার পিতা দারুণ বেদনায় এগামেমননের কাছে এসে বহু মিনতি করে বললেন, হে দেশের রাজা, হে বীর, আমার বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বনকে আপনি হরণ করবেন না। ওকে নিয়েই আমি বেঁচে আছি। কন্যার অদর্শনে আমি বাঁচবো না। দয়া করে আমার নয়নের মণিকে ফিরিয়ে দেন।
এগামেমনন বৃদ্ধের কন্যাকে তো ফিরিয়ে দিলেনই না, বরং হুকুম দিলেন, এ লোকটাকে এইখান থেকে তাড়িয়ে দাও।
সাধু মহাজনকে ব্যথা দিলে তার ফল হাতে হাতে ফলে। এগামেমননের এই দুর্ব্যবহারের কী ফল হবে তা তোমরা একটু পরেই বুঝবে। সাধু দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন–হে খোদা, তুমি এর বিচার করো। খোদা সত্যই সাধুর কাতর নিবেদন শুনলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রিক সৈন্যদের মাঝে খোদার অভিশাপ এসে দেখা দিল। তাদের মধ্যে ভায়নক কলেরা আরম্ভ হল।–সে যে কী ভীষণ ব্যাপার তা বুঝে উঠা কঠিন। মানুষের পাপের জন্যে তাকে অনেক সময় খোদার গজব নাজেল হয়, তা জান? এ কলেরা আর কিছু নয়–এগামেমননের পাপে খোদার গজব।
প্রায় ১৫ দিন ধরে এই ভীষণ ব্যাধির প্রকোপ চলতে লাগলো–গ্রিকরা ভাবলো, যুদ্ধবিগ্রহ ফেলে যার যার প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।
কী কর্তব্য ঠিক করবার জন্যে একটা সভা আহুত হল। সভার মাঝে এক জ্ঞানবৃদ্ধ মহাজন গম্ভীর স্বরে বললেন–তোমরা কি জান, খোদা কেন এই ভীষণ ব্যাধি আমাদের উপর পাঠিয়েছেন? এগামেমনন কি পাপ করেছে, তার খবর তোমরা রাখ? সে জনৈক সাধুর কন্যাকে হরণ করেছে। সাধু যখন কাঁদতে কাঁদতে এগামেমননের কাছে কন্যা ফিরিয়ে পাবার জন্য বলেছিল তখন তাকে বড় অপমান করে এগামেমনন তাড়িয়ে দিয়েছে। সাধুর অভিশাপই আমাদের এই বিপদের কারণ।
এগামেমননও সেই সভায় ছিলেন। বৃদ্ধের বাক্য শেষ হলে তিনি সরোষে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–দুর্বৃত্ত, তুমি বহুবার আমার ক্ষতির চেষ্টা করেছ। আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি যে একজন বকধার্মিক, তা আমার জানা আছে। এচিলীস কুমারী ব্রীসাসকে লাভ করেছে, সে বেলা তোমার মুখ ফোটে নি। আমার বেলায় ধর্মজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছ!
ক্রোধে এচিলীস বললেন–এগামেমনন, মুখ সামলে কথা বলো। কারো মনে ব্যথা দিয়ে আমি ব্রীসাসকে লাভ করি নি। তা ছাড়া যুদ্ধ জয়ের পরে লব্ধ ধনসম্পত্তি সকলের মধ্যে সব মতানুসারে ভাগ হয়েছে–তোমার ভাগ্যে যা পড়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাক। তুমি অবিলম্বে সাধুর কন্যাকে ফিরিয়ে দাও।