সেই পুরুষ বললেন–মুক্তির পথ আছে। সে কাজ কি করতে পারবে? ওদেসিজ বললেন-পারবো, নিশ্চয় পারবো।
স্বপ্ন পুরুষ–তোমাদের মুক্তির পথ বলে দেবার জন্যেই আজ আমি এখানে এসেছি। আমার দেরি করার যো নেই। শোন, এগামেমননের কুমারী কন্যাকে যদি কোরবানি দিতে পার, তা হলেই তোমরা মুক্তি পাবে, নইলে নয়। এই কথা বলেই স্বপ্ন পুরুষ অদৃশ্য হলেন।
প্রাতঃকালে উঠে ওদেসিজ বন্ধু ও দলপতিগণকে সব বৃত্তান্ত বললেন। সকলেই স্বপ্ন পুরুষের কথা বিশ্বাস করেন। সকলে দল বেঁধে এগামেমননের কাছে যেয়ে বললেন–তোমার মেয়েকে কোরবানি দিয়ে আমাদের উদ্ধার করো। গত রাত্রে এক মহাপুরুষ স্বপ্নে ওদেসিজকে বলে গেছেন তোমার কুমারী কন্যার জীবন দানের উপর শুধু আমাদের নয়, জাতির সম্মান নির্ভর করছে।
এগামেমনন একবার মুখ তুলে দলপতির রক্তচক্ষুর পানে তাকালেন। তাঁদের মুখে কঠিন ইচ্ছার ছায়া দেখে এগামেমননের মনে ভয় হল।
এগামেমননকে চুপ করে থাকতে দেখে তাঁরা রেগে বললেন–কাপুরুষ, জাতির সম্মানের জন্য, খোদার উদ্দেশ্যের পথে কন্যার হৃদয়রক্ত দান করতে সঙ্কোচ বোধ করছো? গ্রিক জাতির মুখে কালি দিয়ে, লক্ষ নর-নারীর মাথা অপমানে নত করে তুমি তোমার কন্যাকে বাঁচাবে? এই তোমার বীর জীবনের ইচ্ছা? বল, তোমার ইচ্ছা কী? এগামেমনন মৃদু কণ্ঠে বললেন–রাজি আছি।
এগামেমননের পত্নীর কাছে লোক গেল। কন্যাকে কোরবানি করা হবে, এ কথা না বলে, লোকটি বললে–বীরবর এচিলীসের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে হবে। আপনার স্বামী অবিলম্বে মেয়েকে নিয়ে যেতে বলেছেন। মা মহাআনন্দে মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন।
মেয়ে এসে দেখলেন, বিয়ের কোনো উৎসব হচ্ছে না। বাঁশির গান, ফুলের মালা কিছুই নেই। কতকগুলি রাজা ছুরি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।
যথাসময়ে তাকে সব কথা বলা হল–পিতার পাপের জন্য তাঁর জীবন নেওয়া হবে। কন্যা ভীত হলেন না। তিনি নির্ভীক চিত্তে ঘাতকের ছুরির মুখে গলা এগিয়ে দিলেন। সমুদ্রের নীল পানি চতুর্দিকে থই থই করছিল। একবার মেয়ে বাপের মুখের দিকে তাকালেন–তার পর বীরবালার মতো বললেন–চালাও। ছুরি উঠাতেই কোথা থেকে একটা ঝড় এসে মেয়েকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। খোদা তাকে বাঁচালেন,–খোদার ইচ্ছায় যে প্রাণ দিতে যায়, খোদা তাকে রক্ষা করেন।
০৩. গ্রিকরা ত্রয় নগরের তীরে
যথাসময়ে গ্রিকরা ত্রয় নগরের তীরে এসে উপস্থিত হলেন। পথে তাঁরা একটা বড় নিষ্ঠুর কাজ করেছিলেন। একজন সঙ্গীর সাংঘাতিক পীড়া হয়–কিছুমাত্র লজ্জাবোধ না করে পীড়িত লোকটিকে সমুদ্রের এক দ্বীপের মাঝে তারা তাকে রেখে এসেছিলেন।
মেনেলাস ও ওদেসিজ যখন জাহাজ ছেড়ে তীরে নামলেন, তখন ত্রয় শহরের বুড়ো রাজা প্রিয়াম এবং আরও একজন ভালো লোক তাদেরকে আদর করে বাড়ি নিয়ে যেয়ে বললেন–আপনাদের সঙ্গে আমার ছেলে যে কুব্যবহার করেছে, সেজন্য আমি বড় লজ্জিত আছি। শুধু যে হেলেনকে ফিরিয়ে দেবো তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণস্বরূপ অনেক টাকাও দেবো-আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন।
মেনেলাসও ওদেসিজ খুব খুশি হয়ে রাজা আর সেই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলেন। সে ভদ্রলোক রাজদরবারেরই একজন।
এই সময় যুবক পেরিস ক্রোধে মেনেলাসকে শুনিয়ে বললেন–যে রহ আমি হাতে পেয়েছি,তাকে কিছুতেই ছাড়বো না। যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে দেরি না করে নগরের। সীমা ত্যাগ করে বাড়ি চলে যাও। মেনেলাস ও ওদেসিজ নিতান্ত অপমানিত হয়ে নিজেদের দলে ফিরে এলেন।
এরপর ভীষণ যুদ্ধ বেধে উঠলো। ত্রয়-বাসীদের মধ্যে যুদ্ধের সাড়া পড়ে গেল। রাজা প্রিয়ামের বড় ছেলে হেক্তর হলেন তাদের সর্দার–আরও অন্যান্য বহু লোক তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।, গ্রিকেরা জাহাজ ছেড়ে তীর বল্লম নিয়ে কূলে নামলেন। অসংখ্য মানুষের মাথা–তা দেখলে তোমরা অবাক হয়ে যেতে, তোমাদেরও গায়ের রক্ত নেচে উঠত!
জনৈক গ্রিক যুবক প্রথমেই বীরদর্পে শত্ৰুদলের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ালেন, আর সঙ্গে সঙ্গে হেকতর তার দীর্ঘ তরবারির আঘাতে তার মাথাটা কেটে ফেললেন–তার পর ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। তোমরা যেমন ছুরি দিয়ে কচু কেটেছ, ত্রয়-বাসীরা তেমনি গ্রিকদের কেটে ফেলতে লাগলো। সে কী ভয়ানক দৃশ্য!
বীরবর এচিলীস রক্তের স্রোতকে উপেক্ষা করে তার বিরাট তলোয়ারখানা আকাশের দিকে ধরে উচ্চকণ্ঠে বললেন–এচিলীসের সম্মুখে কে আসতে সাহস কর, এস।
সম্মুখে সাইনাস নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল। ত্রয় দলের যোদ্ধাদের মধ্যে এ লোকটি ভয়ানক বীর–যেমন তার দীর্ঘ বিরাট দেহ, তেমনি তার অস্ত্র নিক্ষেপে পারদর্শিতা। তার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল! তার ঘোড়াটাই বা কত বড়! আর কেউ হলে তার সম্মুখে যেতেই বেহুশ হয়ে পড়তে, কিন্তু এচিলীস দমলেন না। এচিলীসও তো কম বীর নয়–পরী-মায়ের রক্ত তার শিরায় শিরায় বইছে। তিনি ভীমবেগে দীর্ঘ ধারাল বর্শা ফেলে সাইনাসের বুকে আঘাত করলেন! বর্শা জোরে ঘুরে এল। সাইনাসের গায়ে পুরু লোহার কোট ছিল–বর্শার আঘাতে তার বুকের উপর থেকে আগুনের ফুলকী বের হল, তবু বিশেষ কিছু হল না। এইবার ভীষণ গদা তুলে এচিলীস তার মাথায় আঘাত করলেন। এবারও আঘাত ব্যর্থ হল। এচিলীস বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমার আঘাত তো কোনোদিন ব্যর্থ হয় নি!