গ্রিস ক্ষেপে উঠল। পেরিসের দেশ, ত্রয় নগর, পুড়িয়ে ছাই করে হেলেনকে উদ্ধার করতে হবে, এই হল তাদের প্রতিজ্ঞা। যে কথা সেই কাজ। হাজার হাজার জাহাজ সমুদ্রকূলে জমা হল। লক্ষ লক্ষ বীর যুবক যুদ্ধসজ্জায় বন্দরে এসে উপস্থিত হল।
প্রতিশোধের একটা বিরাট বিপুল আয়োজন দেখে এহগামেমননের মন গর্বে পূর্ণ হয়ে উঠলো। পেরিসের পরাজয়ের কথা চিন্তা করে তাঁর মনে গভীর আনন্দ হল।
বীরবর ওদেসিজ প্রথমে এই যাত্রায় যোগ দেন নি। বিয়ের পরই যুদ্ধে যাবার ডাক পড়ল কি না নববধূকে ছেড়ে যেতে তার মন সরছিল না। যেন পাগল হয়েছেন, এই ভান করে তিনি সমুদ্রকূলে যেয়ে লাঙ্গল চাষ আরম্ভ করলেন–কিন্তু তাঁর এই চালাকি জ্ঞানবৃদ্ধ পালমিদাস বুঝতে পারলেন। জব্দ করবার জন্য তিনি ওদেসিজের খোকা তেলিমেকাকে নিয়ে লাঙ্গলের সামনে ফেলে দিলেন, ওদেসিজ অমনি লাঙ্গল থামিয়ে ফেললেন। পাগলের কি জ্ঞান থাকে?–পালমিদাস হেসে ওদেসিজকে বললেন–দাদা, তোমার চালাকি বুঝতে পেরেছি-যুদ্ধে তোমাকে যেতেই হবে। ওদেসিজ শেষে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তাঁর মনে বড় রাগ হল। পরে এইজন্যে ওদেসিজ পালমিদাসকে খুব জব্দ করেছিল।
তোমাদের মনে আছে–রাজা পেলাস পরী-কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। এর নাম তিতিশা। পরে দেখবে, এই বিয়ে হতেই এই কাহিনীর সব অনর্থ শুরু হয়েছে। যাই হোক, এঁদের এক ছেলে হয়েছিল–তাকে সবাই নাম দিয়েছিলেন এচিলীস (খরগোস)। এচিলীস ভারি তুখোড় ছেলে–পরীর বাচ্চা কি না! দৌড়াতে, ঘোড়ায় চড়তে, তীর ছুঁড়তে, লেখা পড়ায় সকল দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। চোহারাও অতি সুন্দর। তাই এই তামাসার নাম। এখন এচিলীসকেও যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ছেলে জন্মাবার পরই পণ্ডিত এনে মা তার কপাল গুনেছিলেন। তারা গুনে বলেছিলেন–এই ছেলের যশে পৃথিবী ভরে উঠবে, কিন্তু যুবক বয়সেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মা এই কথা শুনে মনে করে ছেলেকে কিছুতেই যুদ্ধে পাঠাতে ইচ্ছা কচ্ছিলেন না। কিন্তু দেশের লোকের কথা তো না করা যায় না। তাই তিনি গোপনে এচিলীসকে বহু দূরে–এক রাজার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
এই রাজার কয়েকটি মেয়ে ছিল। কী করে এচিলীসকে গোপন করে রাখা যায়, এই চিন্তায় তিনি অনেকটা বিব্রত হয়ে উঠলেন। শেষে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন। রাজার সাত মেয়ে ছিল, তিনি এচিলীসকে বালিকার পোশাক পরিয়ে তাদের সঙ্গে রাখলেন। কেউ বুঝতে পারলো না। এচিলীস মেয়ে-মানুষের পোশাকে এখানে লুকিয়ে আছে।
রাজার সেজো মেয়ে যেমন পরীর মতো খুবসুরত তেমনি সৎস্বভাব। এচিলীস তারই সঙ্গে বেশি করে মিশতেন। তার মিষ্টি কথা, তার সরল ব্যবহার এচিলীসেকে মুগ্ধ করে দিলো–তিনি তাকে বড় ভালবাসলেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা, দেশের কথা সব ভুলে গেলেন। একটা রঙ্গিন স্বপ্নে তাঁর দিনগুলি সুখে কেটে যেতে লাগলো।
একদিন হঠাৎ এক বিদেশী কতকগুলি পণ্যদ্রব্য এনে রাজপ্রাসাদে ঢুকলো। কত রং বেরং-এর কাপড়, কত বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ তাঁর ঝাঁকার মধ্যে স্তরে স্তরে সাজান ছিল। মেয়েরা ঘিরে সেই সব জিনিসপত্র দেখতে লাগলো।
এচিলীসও নারীবেশে মেয়েদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই ঝাঁকার দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি নারীর পোশাক পরলেও অন্তরে তাঁর পুরুষের তেজ ঘুমিয়েছিল। মেয়েরা সুদৃশ্য হার, গয়না
আর জরির পোশাক নাড়া-চাড়া করছিলেন–এচিলীস সে সব ফেলে একখানা তলোয়ার তুলে তার ধার পরীক্ষা করতে লাগলেন। ব্যস! আর যাবেন কোথায়? যাকে তোমরা সওদাগর বলে মনে করছ, ইনি হচ্ছেন গ্রিসের বড় বীর ওদেসীজ। মিথ্যা সাজে এচিলীসের খোঁজে বের হয়েছেন। ওদেসীজ এচিলীসের হাত ধরে বললেন–তোমাকে চিনেছি। এখন নারীর পোশাক রেখে তীর তলোয়ার হাতে করে বেরিয়ে পড়। সমস্ত গ্রিসের বীর যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হচ্ছে আর তুমি এইখানে মেয়ে-মানুষের পোশাক পরে লুকিয়ে আছ?
যথা সময়ে হাজার হাজার বীর ত্রয় দেশের দিকে যাত্রা করলেন। সে কী দৃশ্য! অগণিত তীর, তলোয়ারের আস্ফালন, সহস্র মুখের মিলিত ধ্বনি। এগামেমননের মনে তা দেখে অহঙ্কার হল, তাঁর মনে হল তিনি যেন সমস্ত দুনিয়া জয় করতে পারবেন। গর্বে খোদার নামটি পর্যন্ত ভুলে গেলেন–অহঙ্কার করে আল্লাহকে উপহাস করে কথা বলতে লাগলেন।
একদিন গভীর রাত্রে সমুদ্রবক্ষে নাবিকেরা দিগৃহারা হয়ে গেল–এত করে তারা ঠিক পথে জাহাজ চালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা হল। সাত দিন সাত রাত্রি তারা কিছুই ঠিক করতে না পেরে শেষে সমুদ্রকূলের এক পাহাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হল। সেই পাহাড়ে ভীষণ জঙ্গল ছিল। বীরগণ ভাবতে লাগলেন–কোথায় হয় নগরে যুদ্ধ করে গৌরব অর্জন করবো, তানা, কোথায় পথ ভুলে এসে উপস্থিত হলাম। এখন উপায় কী?
জাহাজ খুলে পুনরায় পথের সন্ধানে যে তারা বের হবেন সে সুবিধা হল না, কারণ উল্টো দিক থেকে এমন প্রবলভাবে বাতাস বইতে লাগলো যে, কার সাধ্য জাহাজ এক রশি চালায়। তার পর তারা একমনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন।
একদিন ওদেসিজ স্বপ্ন দেখলেন–এক ব্যক্তি তাঁকে বলছেন, এগামেমননের পাপে তোমাদের সকলকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এগামেমনন বড় অহঙ্কারের পরিচয় দিয়েছে এবং সেই কারণে তোমাদের মাথায় এই অভিশাপ পড়েছে। জান তো, খোদা অহঙ্কার ভালবাসেন না। ওদেসিজ সেই স্বপ্নপুরুষকে জিজ্ঞাসা করলেন–তা হলে এই অভিশাপ হতে কী করে মুক্ত হই? দয়া করে বলে দিন।