এদিকে ওদেসিজ ও দায়োমিদাস সহসা অতর্কিতভাবে মন্দির রক্ষীকে আক্রমণ করলেন। দুই বীরের আক্রমণ সে সহ্য করতে পারলো না, দু-এক মিনিটের মধ্যেই সে প্রাণ হারালো।
তার পর দুই বীর ষাঁড়ের গলার রশি ধরে পথ চলা আরম্ভ করলেন। রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য, যতগুলো পাহারাওয়ালা তাদের সামনে পড়লো, সবগুলোকেই তারা মেরে ফেললেন। সদর দরজার কাছে সবাই ঘুমিয়েছিল, সুতরাং সহজেই তারা বিনা বাধায় নগর পার হয়ে এলেন।
পরের দিন বিপুল আনন্দে গ্রিক সৈন্যরা বিপুল বেগে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঘিকেরা কোনই সুবিধা করতে পারলে না।
শেষে একদিন সমস্ত গ্রিক সৈন্য ও গ্রিক বীরদিগকে এক সঙ্গে করে ওদেসিজ বললেন, ভাইগণ, যুদ্ধ করতে করতে একেবারে শেষ হয়ে চলোম, কিন্তু তবুও তো আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কোনো আশা দেখি না। আমি এক মতলব করেছি, কোনো বিশেষ কৌশল করে যদি জয়লাভ করতে পারি, নইলে আর কোনো আশা নেই। সকলে জিজ্ঞাসা করলে, কী মতলব?
ওদেসিজ বললেন, আমাদেরকে প্রকাণ্ড একটা কাঠের ঘোড়া তৈরি করতে হবে–এতবড় ঘোড়া যার পেটের মধ্যে দু’শো সাহসী বীর লুকিয়ে থাকতে পারে। ঘোড়া তৈরি হলে আমাদের দুশো সৈনিক সেই ঘোড়ার পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে। আর একটি লোককে হাতপা বেঁধে ঘোড়ার পায়ের কাছে রেখে দিতে হবে। তার পর সমস্ত তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে বাকি সকলে জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে। এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আমরা ত্রয় অধিকার কবার আশা ত্যাগ করে যাচ্ছি।
তার পর যখন ত্রয়বাসীরা আমাদেরকে পালিয়ে যেতে দেখে উল্লাসে বেরিয়ে আসবে তখন দেখবে এই প্রকাণ্ড ঘোড়াটিকে, কৌতূহলী হয়ে তারা এই আজব জীবটাকে শহরের মধ্যে নিয়ে যাবে।
যে লোকটির হাত-পা বেঁধে ছেড়ে যাওয়া হবে–তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে সে একজন বিদেশী, দুষ্ট গ্রিক সৈন্যেরা তাকে কোরবানি দেবার জন্যে হাত-পা বেঁধেছিল; সে কোনো রকমে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল। ত্রয়বাসীরা নিশ্চয়ই এই কথা শুনে লোকটির বাঁধন খুলে দেবে।
তারপর তারা যখন ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে যাবে, সে সৈনিকটিও সঙ্গে যাবে! সময় বুঝে সৈনিকটা কোনো সঙ্কেত করবে, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পেট চিরে আগুনের বেগে সেই দুশো সৈন্য বের হয়ে পড়বে–শহরের ভিতরে একবার প্রবেশ করতে পারলে কি আর রক্ষা আছে! তার পর ত্রয়বাসী ও তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ লেগে যাবে। এদিকে সেই পরিত্যক্ত সৈনিকটাও পাহাড়ের উপরে একটা ভয়ঙ্কর আগুন তৈরি করবে, যা দেখে যারা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের মাঝে অদৃশ্য হয়েছিল তারা অবিলম্বে ফিরে এসে নগর আক্রমণ করবে, ব্যস! এইরূপে আমারা ত্রয় দখল করবো।
ওদেসিজের এই প্রস্তাব সকলেই পছন্দ করলেন। মিস্ত্রি দিয়ে অবিলম্বে একটা প্রকাণ্ড কাঠের ঘোড়া তৈরি করা হল।
ঘোড়া তৈরি হল দুশো জন সাহসী শক্তিশালী বীর অস্ত্র নিয়ে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পেটের মধ্যে দুশো লোক ধরে এমন একটা ঘোড়া যে কতবড় তা বুঝতেই পাচ্ছ। আট দশটা হাতি এক সঙ্গে করলে যত বড় হয় ঠিক তত বড়।
তার পর হৈ-হৈ রৈরৈ করে সমস্ত তাঁবু ও অন্যান্য জিনিসপত্র আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল-একটা লোককে হাত-পা বেঁধে ও শরীরে কাদা মাখিয়ে বালির ওপর ফেলে রাখা হল। এদিকে ত্রয়বাসীরা গ্রিক সৈন্যের ভেতরে এই অদ্ভুত অগ্নিকাণ্ড দেখে ভারি আশ্চর্য হল। তারা আরও দেখলো–গ্রিকেরা পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে জাহাজ ছেড়ে ত্রয় নগর ত্যাগ করছে।
এই দেখে তাদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতে লাগলো। দলে দলে তারা পলাতক শত্রুর পলায়ন-যাত্রা দেখবার জন্যে সমুদ্রকূলে এসে দাঁড়ালো।
একটা লোককে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে তারা জিজ্ঞাসা করলে তোমার কী হয়েছে?
লোকটি কেঁদে কেঁদে বললে-শয়তানেরা আমার হাত-পা বেঁধে কোরবানি করতে চেয়েছিল, আমি কোনো রকমে রাত্রির অন্ধকারে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছি। এখন তোমরা আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও, ব্যথায় মরে যাচ্ছি। সকলে তাড়াতাড়ি তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলে।
সেই প্রকাও ঘোড়াটি দেখে অবাক হয়ে তারা জিজ্ঞাসা করলে–এটা কী?
লোকটি বললে–এটা হচ্ছে প্রকাণ্ড ঘোড়া। ত্রয় নগর জয় করে জয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ। ওটাকে তারা নগর দুয়ারে খাড়া করে রাখতে চেয়েছিল–এত বড় তাদের দুরাশা!
ত্রয় বাসীরা বললে–বটে! আচ্ছা তা হলে গ্রিকদের পরাজয়ের স্মৃতিস্বরূপ ওটাকে আমরা নগর দুয়ারে রাখবো, অনন্তকাল ধরে তাদের কলঙ্ক এই ঘোড়া বুকে করে রাখবে।
যখন তারা নগর-দুয়ারে পৌঁছল, তখন নগরবাসীরা বললে–গ্রিকদের পালায়নের এই কলঙ্কচিহ্নটি প্রথমে শহরে সকল নর-নারীকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াও। তার পর ওখানে এনে রাখা যাবে। উত্তম কথা বলে তারা সকলে মিলে প্রকাণ্ড জানোয়ারটিকে টানা আরম্ভ করলে। শহরের প্রায় মাঝখানে তারা ঘোড়াটাকে টেনে আনলে, তখন সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সহসা ঘোড়ার পেটের কাছে একটা শব্দ হল। আর কি রক্ষা আছে? গ্রিকবীরেরা হঠাৎ ঘোড়ার পেটের ভেতর থেকে হুড় হুড় করে বেরিয়ে পড়লো। ত্রয়বাসীরা প্রথমে তো অবাক। শেষ কালে তারা গ্রিকদের চালাকি বুঝতে পারলো, কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না।