যুবক বললেন–আমি রাজার ছেলে।
ওদেসিজ–এখানে কী কচ্ছ?
যুবক–মনের আনন্দে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
তার পর সে ওদেসিজকে জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে?
ওদেসিজ বললেন–আমি ওদেসিজ, তোমাদের শত্রু।
যুবক–এ জগতে আমার শত্রু কেউ নেই। তুমি কী করে আমার শত্রু হলে?
ওদেসিজ আশ্চর্য হয়ে বললেন–আচ্ছা, আচ্ছা, শত্রু নয়–মিত্র।
যুবক–মিত্র? বেশ। তোমরা এখানে কী করছো?
ওদেসিজ–তোমাদের জয় নগর দখল করা আমাদের উদ্দেশ্য?
যুবক–সে হবার যো নেই।
ওদেসিজ–কেন?
যুবক-নগরের মাঝখানে একটা উপাসনার ঘর আছে। সেখানে বছর বছর একটা বড় ষাঁড় কোরবানি হয়ে থাকে। সেই কোরবানির ষাঁড় যেদিন চুরি যাবে সেই দিন ত্রয়নগর বিদেশীদের হাতে পড়বে, এ আমাদের ধর্ম-শাস্ত্রের কথা।
এই কথাগুলো বলতে বলতে পাগল যুবকটি আপন মনে গান করতে করতে চলে গেল! সে ভেবেছিল, নগরের মাঝখান থেকে কোনো কালে কারো সাধ্য হবে না যে ষাঁড়কে চুরি করে; তাই সে শত্রুর কানে দিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করে নি। তার মাথাও কিছু খারাপ ছিল।
যাই হোক, তখন ওদেসিজ ফিরলেন। সমস্ত রাত্রি তিনি অনিদ্রায় কাটালেন। পরের দিন যুদ্ধ স্থগিত রইল।
তার পরের দিন সন্ধ্যাকালে নির্জনে দায়োমিদাসকে ডেকে ওদেসিজ সকল কথা খুলে বললেন। দায়োমিদাস বললেন–এ আর কঠিন কাজ কী? সাহস না করলে এ জগতে কোনো কাজই হবে না। সাহস করে আজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ি। যায় প্রাণ যাবে–হয় হেলেনকে উদ্ধার, নতুবা এখানেই মরবো। অন্যায়কে জয়যুক্ত দেখে জীবন-ধারণ করবো না।
ওদেসিজ ভেবে ভেবে ঠিক করতে পারছিলো না যে, কী করে এত বড় একটা ষাঁড় নগরের ভিতর থেকে এত পাহারাওয়ালার চোখের সম্মুখ দিয়ে চুরি করে আনা যেতে পারে! দায়োমিদাসের কথায় তার মনে উৎসাহ এলো।
সত্যই তো, সাহসী যে সে-ই জগতে জয়লাভ করে–কাপুরুষ কোনো কালে বড় কাজ করতে পারে না। ওদেসিজ বললেন–তা হলে এ কথা আর কাউকে বলা হবে না। মনের মতলব অনেককে বললে তর্কের বন্যায় আসল কাজ মোটেই হয় না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। কিন্তু একটা কৌশল করে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। নগরের বড় পথে যে পাহারাওয়ালা রয়েছে তার চোখে ধূলো দেওয়া চাই। কিছু খেয়ে দুই বন্ধু এক নির্জন স্থানে যেয়ে ফকিরের বেশ পরলেন–মুখে মাখলেন ধুলো, ছাই আর বালি। দায়োমিদাস পরলেন হাজার জায়গায় ছেঁড়া এক আলখেল্লা। তার পর নিতান্ত দরিদ্র ভিক্ষুকের মতো কণ্ঠস্বরকে পরিবর্তন করে নগর দুয়ারে যেয়ে ভিক্ষার জন্যে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে এগুতে লাগলেন।
কেউ তাদেরকে বাধা দিল না। ভিতরে প্রবেশ করে ওদেসিজ চুপি চুপি বন্ধুকে বললেন–কোন্ গতিকে ভিতরে প্রবেশ করেছি, এখন কী করে সে জায়গায় যাই?
অনেক নর-নারী রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল, কেউ তাদেরকে গ্রাহ্য করলে না। কেউ হয়তো দয়া করে তাদের হাতে দু-একটা পয়সা দিলে।
অনেক রাত্রি পর্যন্ত তারা ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন, শেষে ক্লান্ত হয়ে এক গাছ তলায় বসলেন। সহসা ওদেসিজ দেখতে পেলেন এক নারীকে।
এ নারী আর কেউ নয় হেলেন। যার জন্যে গ্রিক ও ত্রয় বাসীদের মধ্যে ভীষণ আগুন জ্বলে উঠেছে। ওদেসিজ শিউরে উঠলেন। হেলেন উপাসনা করে ঘরে ফিরছিলেন।
কারো কাছেই মিথ্যা বেশ ধরা পড়ে নি, কিন্তু হেলেনের চোখ ওদেসিজকে চিনে ফেললে। হেলেন ওদেসিজকে দেখেই শিউরে উঠলেন। হেলেন নিকটে এস ভীতি-মাখা কণ্ঠে বললেন–ওদেসিজ, কি ভয়ানক কাজই না করছো! এ শত্ৰুপুরীতে কেন এলে? হায়, এ কালমুখীর জন্যে কত গ্রিক বীর এই অচেনা দেশে প্রাণ দিয়েছে। শেষকালে তোমার মৃত্যুও কি দেখতে হবে? ওদেসিজ দেখতে লাগলেন অবাক হয়ে হেলেনকে–হেলেন তেমনি রূপবতী আছেন। দুঃখ ও চিন্তা তার সৌন্দর্যকে একটু নষ্ট করে নি। ওদেসিজের। মুখ দিয়ে কথা বের হল না।
ওদেসিজ মৃদু স্বরে বললেন–হেলেন, তোমাকে উদ্ধার করবার জন্যে বহু বীর প্রাণ দিয়েছে। আমরাও দিতে এসেছি।
হেলেন সজল নয়নে বললেন-হে বীর, এই পাপিনীকে তোমরা ভুলে যেতে পারলে? কে পরের জন্যে প্রাণ দেয়? বিশেষ করে, নারীর জন্যে রাজার কি পত্নীর অভাব?
ওদেসিজ–হেলেন, তুমি যে আমাদের দেশের মেয়ে, গ্রিকবাসীর রক্ত যে তোমার বুকে! মেনেলাসের একমাত্র পত্নী তুমি। আর কোনো পত্নী তার ছিল না, ভবিষ্যতে আর হবেও না।
হেলেন–আমার স্বামী কি আমাকে গ্রহণ করবেন?-আমি যে কুলত্যাগিনী। আমাকে তিনি খুন করে ফেলবেন না?
ওদেসিজ–নারী ভুল করেছিল বলে কি তার ক্ষমা হবে না?
হেলেন–আবার আমি আমার দেশের মুখ দেখবো? আমার স্বামীকে নিয়ে তেমনি করে ঘর কুরবো? স্বামী আমাকে ঘৃণা করবেন না?
ওদেসিজ–চরিত্রহীন পুরুষকে নারী ঘৃণা করে না। ভুলের জন্যে অনুতাপই শ্রেষ্ঠ শাস্তি।
অতঃপর ওদেসিজ তাদের নগর প্রবেশের কারণ বললেন। হেলেন আঁখিজলে ভেসে বললেন, ত্রয় নগর ধ্বংস হোক আমিই তার ব্যবস্থা করে দেবো। এই বলে হেলেন গভীর নিশার কালো বুক উজ্জ্বল করে ছদ্মবেশী দুই বীরকে নিয়ে শহরের মাঝখানে সেই ষাঁড়ের কাছে এলেন, তার পর বললেন, ওদেসিজ, প্রার্থনা করি খোদা তোমাদেরকে রক্ষা করুন, আমার চোখের পানি যেন ফেলতে না হয়; আমি আর দেরি করতে পাচ্ছি নেপাছে কেউ সন্দেহ করে। এই কথা বলে হেলেন সে স্থান ত্যাগ করলেন।