নেস্তর মাথা নত করে সে স্থান ত্যাগ করলেন। সন্তানের মৃত্যুব্যথা তার বুক ভেঙ্গে দিচ্ছিল। তিনি এচিলীসের কাছে যেয়ে বললেন–মেমন আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে, এর প্রতিশোধ চাই।
অবিলম্বে এচিলীস মেমনের দিকে ছুটলেন। দুই বীরে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। চারদিকের সৈন্যগণ সে ভীষণ লড়াই দেখতে লাগলো।
দুই বীর ভীষণভাবে যুদ্ধ করতে লাগলেন, মরণ-বাচনের কথা তারা ভুলে গেলেন। তলোয়ার নিক্ষেপের তালে তালে তাদের টুপির পালক কেঁপে উঠছিলো। দুজনের মুখেই। ক্রোধের আগুন ঝলকে ঝলকে জ্বলে উঠছিলো। দুজনের শরীরের ক্ষত-পথ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো, কিন্তু কারও সেদিকে লক্ষ্য নেই। ওপর হতে ফেরেশতারাও এই দুই বীরের যুদ্ধ দেখছিলেন। কে জিতবে, কে হারবে–তা তাঁরাও ঠিক করতে পারছিলেন না। বাপরে। বাপ, সে কী ভয়ানক লড়াই!
হঠাৎ সূর্য অস্ত গেল, সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে ভরে উঠলো–দর্শকগণ ভীত-বিস্মিত হয়ে চোখ বন্ধ করলে, তার পর চোখ খুলে দেখলেন, ইথিওপিয়ার রাজা মাটিতে পড়ে আছে–আঁধার তখন কেটে গেছে, আবার সূর্য দেখা দিয়েছে। হঠাৎ আবার আঁধার হয়ে গেল, আর সেই আঁধারের মধ্যে রাজার দেহকে যেন অদৃশ্য দুটো হাত শূন্যে তুলে নিয়ে গেল। রাজা মেমনের মা ছিলেন পরী, তিনিই ছেলের মৃতদেহকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়েছিলেন এবং শেষে সাগর-কূলে পাহাড়-মূলে অশ্রুসিক্ত চোখে মাটি দিয়েছিলেন। লোকে বলে, রাজার দেহ কতকগুলি কালো রংয়ের পাখি হয়ে উড়ে গিয়েছিল। আজো তারা সাগরের ধারে উড়ে বেড়ায়।
রাজা মেমনের মৃত্যুতে ত্রয় ও ইথিওপিয়ার সৈন্য ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে লাগলো–গ্রিক সৈন্য তাদের পশ্চাতে তাড়া করতে লাগলো। এচিলীসও ভীষণ বেগে আগের দিনকার মতো নগর দ্বারের দিকে ছুটতে লাগলেন, হঠাৎ পেরিসের একটা তীর এসে তার বুকে লাগলো, তখনই এচিলীস মাটিতে পড়ে গেলেন।
ত্রয়-সৈন্য হঠাৎ জয়োল্লাস করে ফিরে দাঁড়ালো! আজ এচিলীসের মৃত্যু হয়েছে, এ অসম্ভাবিত ঘটনায় তারা উৎসাহে-আনন্দে নেচে উঠলো। আর কে তাদের সঙ্গে পারবে! এচিলীস ছাড়া আর কে নগর দখল করবে? বাকি গুলোতে শৃগাল, এয়সৈন্য তাদেরকে মোটেই ভয় করে না।
এচিলীসের সঙ্গে বীর ওদেসিজ এবং বড় আজাকও ঘোড়া ছুটিয়ে চলছিলেন–মাথায় তাদের আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, কিন্তু তখন শোক করবার সময় ছিল না। ফড়িংয়ের পালের মতো শত্রু-সৈন্য তাদের দিকে ছুটে আসছে।
বড় আজাক ঘোড়া হতে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে বললেন–ভাই, শত্রু-সৈন্য ভীষণ বেগে অগ্রসর হচ্ছে, এচিলীসের দেহকে পিঠে করে দৌড় দিচ্ছি, তুমি পেছনে পেছনে এস।
এচিলীসের বিরাট দেহ, তার লোহার জামা এবং অস্ত্র সব পিঠে করে বড় আজাক ভীষণ বেগে দৌড়াতে লাগলেন, আর ওদেসিজ পেছনে পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে লাগলেন।
এচিলীসের মৃত্যুতে গ্রিক সৈন্যরা এত দুঃখ করল যে, সে কথা আর বলা যায় না। কোনো বীরের মৃত্যুতে তারা এত দুঃখ করে নি।
এচিলীসকে যথাসময়ে উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে গোর দেওয়া হল। এচিলীসের মা, ব্রীসাস এবং অনেক পরী এসে আঁখিজলে শেষ কাজ সম্পন্ন করলেন। ছেলের যে এমন করে মৃত্যু হবে, তিতিশা পূর্ব হতেই তা জানতেন। এচিলীসের কবর এখনও রয়েছে, সেকান্দার শাহ যখন ভারত আক্রমণ করতে এসেছিলেন, তখন তিনি এচিলীসের কবরের কাছ দিয়ে এসেছিলেন।
এচিলীসের কবর দেওয়া হয়ে গেলে তিতিশা বললেন–সন্তানহারা মার মনে কী আঘাত লাগে তা আজ আমি প্রকাশ করবো না–আজ আমার বীর সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দ করবো, সে কাপুরুষের মতো মরে নি–সে মরেছে বীরের মতো।
সেদিনকার মতো যুদ্ধ স্থগিত থাকলো। এচিলীসের বীর-জীবনের প্রশংসা গীত হতে লাগেলো। সৈন্যেরা নানা প্রকার যুদ্ধ ক্রীড়া ও আমোদ উৎসব করতে লাগলেন। বুড়ো নেস্তর বাঁশি বাজিয়ে গান করতে লাগলেন।
“তিতিশার মতো রূপবতী রমণী গ্রিস দেশে আর নেই; অনেক অনেক দিনের কথা, পেলাস তাকে সাগর কূলে পাহাড় গুহায় পেয়েছিলেন; প্রেম ও ভালবাসায় পেলাস তার আঁচল চেপে ধরেছিলেন–তিতিশা পেলাসের হাত থেকে মুক্তি পাবার বৃথা-চেষ্টা করেছিলেন, তার বিয়ের সময় পরী-মানুষ সবাই যোগ দিয়েছিলেন; তিতিশার ন্যায় জ্ঞানবতী ও গুণবতী মহিলা আর নেই–”।
“তার পুত্র এচিলীসের ন্যায় মহাবীর জগতে আর জন্মে নি।”
সৈন্যেরা সকলে সুগন্ধি শরবত খেতে সকলকে অনুরোধ করলে। পরীরা হাত-ধরাধরি করে গান করতে ও বাঁশির তালে তালে পা ফেলে নাচতে লাগলেন।
গান শেষ হল। তিতিশা নেস্তরের মধুর কণ্ঠ ও বাঁশী বাজানোর প্রশংসা করলেন।
এর পর বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ষাঁড়ের লড়াই হল। তারপর আজাক দায়োমিদাস কুস্তী করলেন। আজাক দায়োমিদাসের মাথা ধরে চিৎ ক র ফেলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু দায়োমিদাস চালাকির সঙ্গে মাথাটি খসিয়ে নিয়ে আজাকের পায়ের মধ্যে পা দিয়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন। চতুর্দিকে উল্লাস-চিৎকার ও করতালি হতে লাগলো।
এইভাবে সারাদিন আমোদ-উৎসবে কেটে গেল।
১০. দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে
দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আসল কাজের তো কিছুই হল না। একে একে গ্রিসের সকল বীর মারা গেলেন। একদিন ওদেসিজ বালির মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সময়ে একজন যুবককে দেখতে পেলেন। নিকটে যেয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কে?