এথেন বললেন–দেখ পেরিস, হেরার কথা শুনো না, আতাটি আমাকে দাও। আমি তোমাকে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবার সুবিধা করে দেব। তোমার পুণ্য জীবনের গৌরব পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ছার ঐশ্বর্যের লোভ করো না, সাধুর জীবনের তুলনায় রাজার। জীবনের কোনো মূল্য নেই।
ওনোন ফিস ফিস্ করে পেরিসের কানে বলতে যাচ্ছিল–এঁকেই আতাটি দাও–অমনি এফ্রোদাইত বললেন–আমাকে যদি সোনার আতাটি দাও তা হলে জগতের মধ্যে। শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে তোমাকে ভালবাসবে। সকলের কথাই তুমি শুনেছ, এখন যা ইচ্ছে কর।
পেরিস এফ্রোদাইতকে আতাটি দিলেন। তার পর পরীরা চলে গেলেন।
পেরিস যখন বুঝতে পারলেন তিনি রাজার ছেলে, তখন আর তার সে জায়গা ভালো লাগলো না। পরী বালিকা ওনোনকে তিনি ভুলে গেলেন। একেবারে রাজা প্রিয়ামের কাছে। এসে পেরিস নিজের পরিচয় দিলেন। হাজার হলেও ছেলে–রাজা রানী সন্তানকে বুকে তুলে নিলেন। তার পর সুখে দিন কাটাতে লাগলো, কিন্তু একটা চিন্তা পেরিসকে কষ্ট দিতে থাকলো–কি করে তিনি সেই সুন্দরী কন্যাটিকে খুঁজে বের করবেন। একদিন পেরিস বাপের কাছে বললেন–বাপজান, নানা দেশ ও নগর দেখবার সাধ আমার হয়েছে। আমি জাহাজে চড়ে দেশ ভ্রমণে যাব। কন্যা খুঁজতে বের হওয়াই তার আসল ইচ্ছা। অবিলম্বে রাজার হুকুমে বড় বড় জাহাজ তৈরি হতে লাগলো।
জাহাজ তৈরি হলে পেরিস যাত্রা করবেন, এমন সময় তার ভাই ও বোন বাধা দিয়ে বললেন–ভাইজান, দেশ দেখা দিয়ে কাজ নেই, আমাদের মনে হচ্ছে তোমার এই যাত্রা অনেক অশুভের কারণ হবে। অতএব এই মন্দ কাজ করো না। পেরিস হেসে বললেন তোমরা পাগল!
তার পর একদিন বড় বড় জাহাজে পাল খাঁটিয়ে মহা আড়ম্বরে এজিয়ন সাগরের বুকের উপর পেরিস জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন।
কত দ্বীপ, কত নীল জল অতিক্রম করে পেরিস স্পার্থার রাজা মেনেলাসের রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা করে বাড়িতে আনবার জন্যে রাজা মেনেলাস পত্নী ও পরিজনসহ পেরিসের জাহাজের কাছে এসে বললেন–আসুন যুবরাজ, আমাদের। বাড়িতে দুটি নুন-ভাত খাবেন। পেরিস খুব খুশি হয়ে মেনেলাসের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এলেন। অতিথির আদর-আপ্যায়নের জন্য মেনেলাসের প্রাসাদে দিবা-রাত্রি পান-ভোজন চলতে লাগলো। রানী হেলেন নিজ হস্তে সকলের পরিবেশন করতে লাগলেন।
পেরিস দেখলে রানী হেলেনের মতো সুন্দরী ত্রিভুবনে আর নেই। ভাবলেন, এই তো সেই কনে, যার কথা এফ্রোদাইত বলেছিলেন, কিন্তু কী করে একে হাত করা যায়? হেলেন যে আর এক জনের পত্নী।
কয়েকদিনের জন্যে মেনেলাস অতিথিকে রানীর কাছে রেখে ক্রেতা দ্বীপে একটু বেড়াতে গেলেন। ব্যস, সুযোগ পেয়ে পেরিস রানীকে বললেন–রানী, আমার সঙ্গে চল, ত্রয় নগরে তোমাকে নিয়ে যাই। বিশ্বাসঘাতক রানী বললেন–বেশ চল।
রাজার অনুপস্থিতিতে রানীকে নিয়ে পেরিস ত্রয় নগর অভিমুখে যাত্রা করলেন।
০২. ঈদা পাহাড়ের যুবরাজ পেরিস পরী
সেই যে ঈদা পাহাড়ের যুবরাজ পেরিস পরী এথেন ও হেরার কথা শুনলেন না–ফুটফুটে বৌকে পাবার লোভে তাঁর মতিভ্রম হল–এতে এথেন ও হেরার বড় রাগ হল।
এইবার হেরা ঝগড়ার ঠাকুর এরিসকে দিয়ে দ্রুত মেনেলাসের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন–দুষ্ট পেরিস তার বৌকে নিয়ে পালিয়েছে, শিগগির বাড়ি এসে যা হয় ব্যবস্থা করুন।
মেনেলাস এই দারুণ সংবাদ পেয়ে শোকে অস্থির হলেন। অতিথির বিশ্বাসঘাতকতা। স্মরণ করে সংসারকে নিতান্ত খারাপ স্থান বলে তাঁর মনে হতে লাগলো। অবিলম্বে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন–ঘর-দোর দালান-কোঠা সব খালি। পত্নী হেলেন নাই।
কি যে ব্যথা তাঁর মনকে কাঁদিয়ে তুললে তা আর বলে কী হবে? আহা, তাঁর জীবনের সঙ্গিনী কী করে তাকে ফেলে চলে গেল? মেনেলাস ভাবলেন–এ সংসারে আমার কেউ নেই। বৃথা আমার টাকা-কড়ি।
দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে খুব ক্রোধ হল। দারুণ উত্তেজনায় তাঁর চোখ রক্তময় হল–শরীরের প্রত্যেক পেশী ভীষণ প্রতিশোধের জন্য গরম হয়ে উঠলো। কোথায় সেই নেমকহারাম, শয়তান পেরিস–সে যে বহু দূরে–সেই অকূল সাগরের পারে।
হোক সাগরের পারে। তাঁকে বিনাশ করে হেলেনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যে শয়তান তার বুকে এমনি করে আগুন জ্বেলেছে তার কলিজার রক্ত দিয়ে স্নান করতে হবে।
রাগে দুঃখে মেনেলাস যেন পাগল হয় উঠলেন। তোমরা কি মেনেলাসের মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পাচ্ছ?
কত সুখ, কত প্রেমে মেনেলাস হেলেনের সঙ্গে এতকাল বাস করেছেন! এতটুকু অবিশ্বাস তার মনে কোনোদিন আসে নি। এই কঠিন বেদনা–এই নিষ্ঠুর আঘাতই যদি স্বামীকে দেবে, তবে ওগো হেলেন, কেন মিথ্যা-প্রণয়ে মেনেলাসকে আপন করেছিলে?
মেনেলাস মহিসেন নগরে যেয়ে তাঁর ভাই এগামেমননকে সব কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন–এখন কী করি?
এগামেমনন ভাইয়ের দুঃখে যার পর নাই মর্মাহত হয়ে বললেন–দুষ্ট পেরিস সহজে হেলেনকে ফিরিয়ে দেবে না। এগামেমননের কাছে বীর নেস্তর ছিলেন। পেরিসের কুকাজের কথা সমস্ত শুনে বললেন–সমস্ত গ্রিসবাসীকে এই কুকাজের প্রতিশোধের জন্য লড়াই করতে হবে। এগামেমনন জিজ্ঞাসা করলেন–কেমন করে তা সম্ভব বলুন। আপনি জ্ঞানী। আপনার সুপরামর্শ ছাড়া আমরা কিছু বুঝতে পাচ্ছি না।
নেস্তর বললেন–আমাদের সকলের মুরুব্বি পালমিদাসের কাছে চলুন। তারপর গ্রিসের যে রাজপুত্র, রাজা নীরজের কাছে শপথ করেছিল তাদের কছে যাবো। মেনেলাসের এই বিপদে তাকে সাহায্য করতে তারা বাধ্য। পরী হেরা ও এথেন রাজপুত্র পেরিসের উপর খুব বিরক্ত হয়েছিলেন–তাঁরা এখন সারা গ্রিসের ভিত পরিসের বিরুদ্ধে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে লাগলেন।