রাজা শোকপূর্ণ কণ্ঠে বললেন–আমি কে, তা কি এখনও বুঝতে পারেন নি? ত্রয়ের যে বীরকে আজ আপনি হত্যা করেছেন, আমি তারই পাগল বাপ। আপনি নিজের বাপের কথা চিন্তা করুন–তা হলে বুঝতে পারবেন, কি ব্যথা আজ আমার প্রাণে লেগেছে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, যে আমার ছেলেকে মেরেছে তাঁর দয়া আজ এই গভীর নিশীতে ভিক্ষা করতে এসেছি। যদি আমায় মেরে ফেলতে হয় ফেলুন, কিন্তু আমার ছেলেকে ফেরত দিন। তার মুখোনি শেষ বার দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো। আমার মনে অপমান-জ্ঞান নেই। আপনি বীর, আমার প্রতি কি আপনি করুণা দেখাবেন না?
যখর রাজা এই সমস্ত কথা বলছিলেন, তখন সহসা বাপের স্মৃতি এচিলীসের মনে জেগে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে রাজার হাত ধরে তাঁকে তুললেন, দুজনার চোখেই তখন পানি।
এচিলীস বললেন–রাজা, কী করে এই গভীর নিশীথে শত্রু-সৈন্যের মাঝখানে আসতে সাহস করলেন? আর কেঁদে কী হবে? যতই কাঁদুন ছেলে আর ফিরে আসবে না। আমি আপনার শোক বুঝতে পাচ্ছি, আমার বাপকেও একদিন আপনার ন্যায় কাঁদতে হবে, কারণ আমি জানি, যুদ্ধে আমাকেও এখানে মরতে হবে। আমার পথ চেয়ে আমার বাপও বসে আছেন। আমার বাপের বহু অর্থ সম্পদ আছে, পরী-রাজার মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর মনে অফুরন্ত আনন্দ ছিল, কিন্তু এবার তার সে সুখে দাগ পড়বে। আমি আমার বাপের একমাত্র ছেলে। একটু নীরব থেকে বললেন–মানুষের ভাগ্যের কী পরিবর্তন–আজ যে রাজা, কাল সে ভিখারি; আজ যাকে হাসতে দেখা যাচ্ছে, কাল হয়তো দেখা যাবে; দুঃখ-বেদনায় তার মুখ কালো হয়ে গেছে–চোখে তার পানি। হায় দুনিয়া,
এখানে যশ-অহঙ্কারের মূল্য কী–আর সুখই বা কোথায়?
অতঃপর এচিলীস বাবুর্চীকে বললেন, বাবুর্চী, রাজার সম্মানের জন্যে একটা বড় মেষ জবাই করো। তিনি আমাদের অতিথি। আর তাঁর বিশ্রামের জন্যে স্থান ঠিক করে দাও একটু গোপন স্থানে দিও, কেউ জানতে না পারে। কাল আঁধার থাকতেই উনি ছেলেকে নিয়ে যাবেন।
রাজা প্রিয়ামকে সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় বললেন–রাজা, আর শোক করবেন না। যখন এখানে এসেছেন তখন আপনাকে কিছু খেতে হবে। এ সংসারে বহু রাজার ছেলে মরেছে, কিন্তু কোনো দিন কেউ না খেয়ে থাকতে পারে নি। এচিলীসের অনুরোধে রাজা চুপ করে রইলেন।
যথাসময়ে এচিলীস রাজার হাত ধরে নিয়ে দস্তরখানায় বসালেন। রাজা এচিলীসের প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না, এচিলীসও রাজাকে বিস্তর প্রশংসা করলেন। ভোজন। ও দেখাশোনায় মানুষের মনে দুর্বলতা আসে–যে শত্রু এমন করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে তার প্রতি অকস্মাৎ রাজা প্রসন্ন হয়ে উঠলেন।
তখনও অল্প আঁধার ছিল, ঊষার আলো ভালো করে প্রকাশ হয় নি। এচিলীস ভৃত্য দিয়ে হেরের দেহ রাজার সঙ্গে গ্রিক সীমা পার করে দিলেন।
এদিকে নগর দুয়ারে অসংখ্য লোক জমা হয়েছিল। রাজাকে ফিরতে দেখে দুঃখের মধ্যেও তাদের মনে আনন্দের সঞ্চার হল। হেকতরের মা পত্নী উভয়ে মৃতদেহকে পাগলিনীর ন্যায় বুকে চেপে ধরতে লাগলেন। আত্মীয়স্বজন ও নগরবাসীরা সে দৃশ্য দেখে না কেঁদে থাকতে পারলেন না। অতঃপর নগর-দুয়ার হতে হেরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। পত্নী ও মাতার শোকের শেষ নেই। তারা অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লেন। হেকতর শিশু কোলে বসে স্তব্ধ হয়ে মায়ের এই অস্থিরতা লক্ষ্য করছিল।
হেক-পত্নী শোক করে বলতে লাগলেন–হে স্বামী, আমাকে অনাথিনী করে তুমি, কোথায় চলে গেলে? আমার প্রাণের ব্যথা বোঝবার বয়স এখনও য়ে এই শিশুর হয় নি। শীঘ্রই গ্রিক সৈন্য এসে আমাকে তোমার শিশুসহ বন্দিনী করে নিয়ে যাবে, তার পর আমরা। কোনো গণ্য গ্রামবাসীর বাড়িতে যাবো। তোমার শিশুকে হয়তো কোনো গ্রিক এসে হত্যা করে ফেলবে। তুমি যখন গিয়েছে, তখন, কেউ আর এ নগর রক্ষা করতে পারবে না। তোমার জন্যে আজ সমস্ত ত্রয়বাসী দুঃখ করছে, কিন্তু আমার মতো কঠিন দুঃখ আর কেউ পায় নি। হায়, মৃত্যুকালে তোমার চোখের পানে শেষ চাওয়া চাইতে পারি নি, তোমার তৃষিত মুখে একটু পানি দিতে পারি নি! হায়, হতভাগিনী আমি! এই কথা বলেই তিনি মূৰ্ছিতা হয়ে পড়লেন। কোলের শিশু ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগলো।
শাশুড়ি পুত্রবধূর হাত ধরে পুত্রকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন–হে আমার প্রিয়তম সন্তান, সকল ছেলের চেয়ে তুমি যে আমার অধিক আদরের ছিলে–হায়, তোমাকেই যে আমি প্রথমে পেটে ধরেছিলাম। ওরে হের, তুই যেদিন প্রথম জন্মেছিলি, তোর এই মরণ-বিছানায়ও তোকে সেদিনের মতো তেমনি মধুর, তেমনি সুন্দর, তেমনি হাসি-মাখা দেখতে পাচ্ছি।
তার পর সৌন্দর্যের রানী হেলেনও চোখের পানি ফেলে বললেন–প্রিয় ভাই, আমার সকল দেবরদের চেয়ে তুমিই যে আমায় অধিক স্নেহ করতে। তোমার মুখে কখনও একটা কঠিন কথা শোন নি। তোমার বোন বা আমার কোনো দেবর যখন আমাকে একটুখানি অসম্মান দেখিয়েছে, তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ। বড় ভাইয়ের স্নেহ-মায়া দিয়ে তুমি আমাকে রক্ষা করেছ, আজ তুমি চলে গেলে। তুমি ছাড়া হয় নগরে আমাকে আর কেউ ভালবাসার নেই–আমি যে পাপিনী, অভিশপ্তা হতভাগিনী।
০৯. ত্রয়বাসীরা আজ সভা করছেন
কী কর্তব্য, তাই ঠিক করবার জন্যে ত্রয়বাসীরা আজ সভা করছেন।