হেকতরের মা সে দৃশ্য দেখে হায় হায় করে উঠলেন–বুকে দুই হাত দিয়ে ছাদের উপর বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন।
হতভাগিনী হেকতর-পত্নী আমেকি তখনও তাঁর এই কপালভাঙ্গার সংবাদ পান নি। তিনি সখীদেরকে নিয়ে তাতে বসে কাপড় বুনছিলেন, হঠাৎ বাইরে চিৎকার শুনে চমকে উঠলেন। বললেন–তোমরা কাজ বন্ধ কর, দেখি কী হল–আমার বুক কেন এমন করে করে কেঁপে উঠছে? আমার স্বামী হেরের তো অমঙ্গল হয় নি?
তাড়াতাড়ি ছাদের উপর উঠে দূরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার মাথা ঘুরে গেল। এচিলীস তার রথের চাকার সঙ্গে স্বামীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। হেতর-পত্নী স্বামীর বোনের কোলের ওপর তখুনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।
অনেক চেষ্টার পর যখন হুঁশ হল তখন কপাল মাটির উপর রেখে তিনি বলতে লাগলেন–ওগো স্বামী, এ হতভাগিনী যে এ দৃশ্য দেখতে পারে না; হায়, তোমার কপালে এত অসম্মান লেখা ছিল! সারা সংসার জ্বালিয়ে দিয়েও তো এ অপমানের প্রতিশোধ হবে না, আমার হৃদয় জ্বালা জুড়োবে না। তোমার শিশু যে আমার সঙ্গেই ভিখারি হল; যে ছিল রাজার ছেলে, সে মানুষের খাবার সময় তাকিয়ে থাকবে, তারা হয়তো স্নেহ পরবশ হয়ে এক টুকরো দেবে; কেউ হয়তো চোখ গরম করে খোকার দিকে চাইবে, যাদু আমার কেঁদে ফিরে আসবে! হায়, সে ব্যথা যে আমার সইবে না। ওগো স্বামী, আমার কী হবে? এ শহরের ধ্বংস সুনিশ্চিত–তুমি যখন গেলে, তখন এ শহরের মান-ইজ্জত কে রাখবে? শত্রুরা কুমারীদেরকে দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে–আমি যে এয় রাজার পুত্রবধূ। আমাকেও হয়তো শেষকালে কোনো গ্রিক সওদাগরের বাড়ি পানি গরম করতে হবে। হায়, তাতেও দুঃখ ছিল না, কিন্তু আমার এ শিশুর কী হবে?
মাথায় আঘাত করে করে হেত্তর-পত্নী আমেকি এমন করে কাঁদতে লাগলেন–তাঁর সখীরাও কাঁদতে লাগলেন।
এদিকে এচিলীস বাসায় ফিরে বন্ধু আজিজের মৃতদেহের কবর দিলেন, তার পরে সকলে মিলে জয়ের উৎসব করলেন–দৌড়া-দৌড়ি, কুস্তি, দাঁড়টানা, লাফানো প্রভৃতি নানা প্রকারের উৎসব হল। খেলা শেষ হলে সকলে বিশ্রামের জন্য গেলেন। সকলে আনন্দ করলেও এচিলীসের কোনো আনন্দের কারণ ছিল না, সারা রাত্রি তার ঘুম হল না, বন্ধু আজিজের বিরহ-ব্যথা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল।
পরের দিন সকালবেলা প্রতিশোধের জ্বালা জুড়োবার জন্যে এচিলীস হেক্তরের মৃতদেহ রথের সঙ্গে জুড়ে বন্ধুর কবরের চারিদিকে ঘুরাতে লাগলেন। একদিন দুদিন তিনি।
এমনি করলেন, তবুও তাঁর তৃপ্তি হল না। পাছে ছেলের এই ব্যবহারে খোদা অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিতিশা ছেলেকে এই কাজ করতে নিষেধ করলেন।
সন্ধ্যাকালে প্রিয়াম ছেলের জন্যে নির্জনে বসে কাঁদছিলেন।
হঠাৎ তার কি মনে হল তিনি ভূত্যদিগকে রথখানি সাজাতে বললেন। রানীকে বললেন–ঘরে যত রকমের দামি জিনিস আছে সব বের কর। এইসব দিয়ে আমি একবারে গ্রিকদের কাছে যাবো, টাকা দিয়ে বলে কয়ে কোনো রকমে ছেলের দেহ উদ্ধার করতে পারি কি না চেষ্টা করবো।
রানী কেঁদে বললেন-পুত্র গিয়েছে, সব গিয়েছে, শেষকালে তোমাকেও হারাতে হবে। সেই রাক্ষসের মনে কি দয়া আছে? তোমাকে পেলে কিছুতেই তারা ছাড়বে না! আমি যে নারী, নারী হয়ে কেমন করে এত ব্যথা সইব? আমার তিনটি ছেলেকে তারা মেরে ফেলেছে, এবার স্বামীকেও মারবে। জেনে শুনে কে শত্রুর কাছে ধরা দেয়?
রাজা বললেন–রানী, তুমি যাই বলো, আমি কিছুতেই এ সংকল্প ত্যাগ করবো না। একটি বার আমার বাছাকে বুকের উপর ধরতে চাই, তাতে যদি প্রাণ যায়, আপত্তি নেই। তুমি সত্বর আমার যাবার বন্দোবস্ত করে দাও। তোমার কোনো ভয় নেই–আমারও কোনো ভয় নেই। কে যেন আমার বুকের ভেতর থেকে বলছে–গ্রিক বীরদের কাছে তোমার সন্তানকে ভিক্ষা চাও। তোমার ওপর তারা দয়া করবে?
অনেক রাত্রে বুড়ো রাজা বহুমূল্য উপহার সামগ্রী নিয়ে রওয়ানা হলেন। যখন ঘরের কাছে এলেন, তখন তিনি দেখলেন, একটা লোক সেখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাজার মনে খুব ভয় হল। ভাবলেন, এ কোনো কঠিন-হৃদয় পাহারাওয়ালা হবে। কী করি? পালিয়ে যাবো না এর হাত ধরে আমার দুঃখের কথা বলবো।
লোকটি রাজাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলে–কে এখানে এত রাতে রথ চালাচ্ছেন?
রাজা বললেন, মহাশয়, আমি ত্রয়ের বুড়ো হতভাগা রাজা, আমি সন্তানহারা। কেন এতরাত্রে এখানে এসেছি, তা কী আপনি দয়া করে শুনতে চান?
লোকটি বললে–আপনার মতলব কী তা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার অবস্থা বুঝে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। আমার দ্বারা যদি কোনো উপকার হয়, করতে রাজি আছি।
রাজা বললেন–আপনার দয়ার জন্য আপনাকে ধন্যাবাদ। দয়া করে আমাকে বীর এচিলীসের কাছে নিয়ে চলুন। লোকটি বললে–আপনি দুঃখিত হবেন না। হেক্টরের দেহের ওপর কোনো অত্যাচার হয় নি। এচিলীসের কাছে যেয়ে আপনার প্রার্থনা জানান, তিনি আপনার ন্যায় বুড়ো মানুষের মনে কিছুতেই ব্যথা দেবেন না।
রাজা এই লোকটির সাহায্যে এচিলীসের তাবুর ধারে এলেন। লোকটি বিদায় গ্রহণ করে কোথায় যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল।
এচিলীস তখন সবেমাত্র আহার শেষ করে বাইরে বাতাসে এসে বসেছিলেন, এমন সময় বুড়ো রাজা সেখানে উপস্থিত হলেন। রাজা জানু পেতে বসে তাড়াতাড়ি এচিলীসের হাতখানি ধরে (যে বাহু ত্রয়বাসীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে) চুম্বন করলেন। এচিলীস এবং উপস্থিত আর আর সকলেই অপরিচিত বুড়োর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলেন।