মহাবল নামে এক ত্রয় বীর বুক ফুরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতঃপূর্বে প্রায় সকলে এচিলীসের সুন্মুখ হতে সরে পড়েছিল–মহাবলকে সম্মুখে পেয়ে এচিলীস তার দিকেই দীর্ঘ বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু মহাবলের ভাগ্যবলেই বর্শা তার গায়ে লাগলো না–নিকটে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রায় তিন হাত পর্যন্ত পাথরের মধ্যে বসে গেল, পাথর হতে বর্শা খুলে এচিলীস মহাবলের দিকে ধাবিত হলেন।
রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর বসে রাজা প্রিয়াম ও রানী আজকার এই ভীষণ যুদ্ধ দেখছিলেন–তাঁরা বুঝেছিলেন, এতকাল পরে কে আজ যুদ্ধে নেমেছে, কার সম্মুখ থেকে ত্রয় সৈন্যদল শৃগালের মতো পালাচ্ছে।
রাজার বড় ছেলে হেক্তর তখনও নগরের বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজা তা দেখে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর দুই ছেলেকে ফিরে আসতে না দেখে তিনি বিশেষ সন্দিগ্ধ ও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। রাজা উচ্চৈঃস্বরে হেরকে লক্ষ্য করে বললেন–হেকতর আর বাইরে থেকো না ভিতরে ঢুকে পড়ো। এচিলীস যুদ্ধে নেমেছে, আজ আর রক্ষা নেই। তোমার আর দুই ভাই কই? তারা বোধ হয় জন্মের মতো আমাকে ত্যাগ করেছে।
হেক্তর তবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন–বৃদ্ধ রাজা আবার বললেন হের তুমি আমার বড় ছেলে, তোমার পতন আমি দেখতে পারবো না। বুড়ো বাপের প্রতি কি তোমার দয়া নেই? তুমি মরলে আমাদেরও প্রাণ থাকবে না? শত্রু সৈন্যকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না। তার পর নিজে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন–হায় অদৃষ্ট! নিজের চোখে সন্তানদের মৃত্যু দেখতে হল, আমার মেয়েদেরকে শত্রুরা দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে, আমাকে হত্যা করে শত্রুরা কুকুরকে খেতে দেবে।
দুই ছেলের অদর্শনে রানীও কাঁদছিলেন। তিনিও বুক চাপড়ে বললেন, ওরে হেকতর, বাবা আমার, তোকে যে এই বুকে ধরে মানুষ করেছি, জননীর আজ্ঞা অবহেলা করবি? তোর শিশু পুত্রের কথাও কি মনে হচ্ছে না, তোর পত্নীও কি তোর কেউ নয়?
হের তলোয়ারের উঁটি ধরে নগরের প্রবেশদ্বারের কাছে প্রাচীরে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাহাড়ের ধারে ক্ষুধিত অজগর পথিককে গেলবার জন্যে যেমন তার বিষজিহ্বা বের করে অপেক্ষা করতে থাকে, সাপের নাক দিয়ে যেমন মুহুর্মুহু বিষ নিশ্বাস বের হতে থাকে, হেরের নাক দিয়েও তেমনি করে আক্রোশের আলো বের হচ্ছিল।
হেক্তর আপন মনে বলতে লাগলেন–সন্তান স্নেহে মা-বাপ আজ অন্ধ হয়েছেন। কাপুরুষের মতো এচিলীসের সম্মুখ হতে কেমন করে সরে যাব? এর মতো লজ্জা জীবনে আর আমার নেই–মৃত্যুই শ্রেয়। মা-বাপের স্নেহ,পত্নীর ভালবাসা, লাঞ্ছিত জীবনের কালো কলঙ্ক রেখাগুলি শোধরাতে পারে না। . হেকতর এমন করে ভাবছেন, এমন সময় মহাবীর এচিলীস ঝলসিত তলোয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে দৈত্যের বিক্রমে তাঁরে কাছে উপস্থিত হলেন। হেক্তর আগে যাই ভাবুক না, এচিলীসের সেই সংহারী মূর্তি দেখে চমকে উঠলেন। দারুণ ভয় এসে মুহূর্তের মধ্যে তার বুক চেপে ধরলো। তিনি আর দাঁড়াতে পারলেন না। বালক যেমন করে ভয়ে ছুটে পালায়, হেকতর তেমন করে দৌড় দিলেন। এচিলীসও তার পিছনে পিছনে ছুটলেন।
নগরের চতুর্দিককার দেওয়াল বেয়ে এচিলীস প্রাণপণে ছুটতে লাগলেন। একবার দু’বার তিনবার তারা নগরে ঘুরে এলেন। দৌড়ান ব্যাপারেও এচিলীস ভায়ানক পটু। যেখানে ত্রয় মেয়েরা স্নান করতেন আর কাপড় ধুতেন সেই জায়গায় এচিলীস হেরের নাগাল ধরে ফেললেন।
অগত্যা হের ফিরে দাঁড়ালেন। বর্শাখানি ছুঁড়ে এচিলীসকে মারলেন, কিন্তু এচিলীসের ঢালের সঙ্গে লেগে সেখানি দুই ভাগ হয়ে ভেঙ্গে গেল। হের চিৎকার করে বললেন–ওগো, কে আছ এখানে? একখানি নূতন বর্শা দাও। কিন্তু কে তাকে বর্শা দেবে? কেউ সেখানে ছিল না।
এচিলীস তলোয়ার তুলে হেকতরের গলার হাড়ের কাছে এক আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভায়ানক চিৎকার করে হেত্তর মাটিতে পড়ে গেলেন। আহা, সে কী শোচনীয় দৃশ্য! ত্রয়বাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর আজ ধরাশায়ী হলেন–এতকালের মহাবৃক্ষ আজ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে গেল! কী পরিতাপ!
হেকতর করুণকণ্ঠে বললেন–বীর এচিলীস! আমি চলোম, আমার সকল গর্ব তোমার হাতে আজ চূর্ণ হয়ে গেল। খোদাতালা তোমার হাতে আমার মরণ লিখেছিলেন। দয়া করে আমার মৃতদেহের উপর অত্যাচার করো না–আমাকে মাটি দেবার ব্যবস্থা করো; আমরা আত্মীয়-স্বজনকে আমার দেহটি দিও।
এচিলীস বললেন–অপদার্থ, যে কিছুক্ষণ আগে আমার পরম বন্ধু আজিজের মরা দেহ নিয়ে এত লড়াই করেছে, সে এই অনুগ্রহ চায় কোন লজ্জায়? তোমার দেহ শৃগাল কুকুরকেই দেওয়া হবে। তোমার মৃতদেহের প্রতি কোন সম্মান দেখানো হবে না, কারণ তুমি ও তোমার দেশের লোক বড়ই হীন। হেক্তর করুণ কণ্ঠে বললেন–তোমার নিষ্ঠুর সংকল্পের কোনো নড়চড় হবে না, কিন্তু মনে রেখো, আমার ভাই পেরিস এই হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
এই কথা বলেই হেরের মৃত্যু হল।
এচিলীস আপন মনে বললেন–কপালে যদি থাকে তবে তাই হবে।
এচিলীসের মনে হল–বন্ধু আজিজের দেহ এখনও গোর দেওয় হয় নি, তিনি সৈন্যগণকে সে দিনকার মতো ফিরতে বললেন।
হেরের দেহ এচিলীসের রথের চাকার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। এতকালের গর্বোন্নত মাথা ধুলোবালির সঙ্গে আছাড় খেয়ে খেয়ে রথের চাকার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো।