পোশাকে দুটি নগরের চিত্র এঁকে দেওয়া হয়েছিল। এক নগরের অধিবাসীরা বিবাহ উৎসবের মত্ত! তারা কনেকে মাথায় করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চৈঃস্বরে সকলে কনের রূপ, গুণ ও গান করছিল। যুবকেরা বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসবে বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসব দেখছিল!
দ্বিতীয় নগরে লড়াই বেধেছে।
পোশাকে একটা বিস্তীর্ণ মাঠের ছবিও ছিল। কৃষকেরা জমি চাষ করছে; মোড় ঘোরাবার সময় মেয়েরা তাদের হাতে এক পেয়ালা করে মিষ্টি শরবত দিচ্ছিল। চাষ করবার সময় লাঙ্গলের যেমন করে মাটি দু-ধারে গড়িয়ে পড়ে ছবিতেও ঠিক তেমনি করে পড়ছিল, এমন চমৎকার ভাবে সে ছবি আঁকা।
পোশাকে শস্যে-ভরা ক্ষেতের চিত্রও ছিল। বাতাসে দোল খেয়ে শস্যের মাথাগুলি হেলে হেলে পড়ছে। লোকে গান করে করে শস্যের আঁটি বাঁধছিল, আর ছোট ছোট ছেলেরা সেগুলি মাথায় নিয়ে গাড়িতে তুলে দিচ্ছিলো। দূরে তাদের রাজা বসেছিলেন, আনন্দে তার মুখে হাসি ধরে না–রাজ্য তার শস্য-সম্পদে পরিপূর্ণ।
কতকগুলি লোক একটা ষাড় জবাই করছিল; রমণীরা শ্রমক্লান্ত যুবকের জন্যে রান্না করবে।
একটা লতাপাতা ও ফুলে ভরা উদ্যানের ছবিও ছিল! বাগানের পথে যুবক ও মেয়েরা গান করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হৃদয় তাদের শুদ্ধ ও পবিত্র-আনন্দে ভরপুর।
একস্থানে এক পাল গাভীর চিত্র ছিল। গাভীদের সুন্দর দীর্ঘ শিংগুলি কত শুভ্র। দূরে একটা রক্তচক্ষু ক্রুদ্ধ সিংহ এক ষাড় ধরেছে; ষাঁড়ের গলা দিয়ে অজস্র-ধারায় রক্ত পড়ছে, সিংহ সেই রক্ত খাবে। বড় বড় শিকারী কুকুর সিংহকে আক্রমণ করবার জন্যে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তাদের সাহসে কুলোচ্ছে না। একটা পাহাড়ের ধারে এক পাল মেষ চর ছিল। দূরে একটা ধবধবে ঘর। সেখানে কুমারীরা বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল।
০৮. এচিলীসের মা, তিতিশা
এচিলীসের মা, তিতিশার দেওয়া অস্ত্রগুলি প্রভাতের অরুণ কিরণে ঝক ঝক করছিল। তিতিশার পরী সহচরীরা তা দেখে শিউরে উঠলেন।এচিলীসের মন কিন্তু আনন্দে নৃত্য করতে লাগলো, কারণ সেইসব তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়েই সৈন্যদের মাথা কাটা হবে। ত্রয়বাসীরা অন্যায় ও পাপ করেছে, সুতরাং তাদের শাস্তি দিতে এচিলীসের মনে কোনো দুঃখ হচ্ছিল না। কি জন্যে যে এই যুদ্ধ বেধেছে তা তো তোমরা জান।
তিতিশা আজিজের মৃতদেহের পাশে বসে ক্ষত স্থানগুলিতে আরক লাগাতে লাগলেন, যাতে ক্ষতগুলি পচে না ওঠে। এচিলীস বাইরে যেয়ে সকলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
গ্রিক সৈন্যরা আনন্দ-উৎফুল্ল মনে বেরিয়ে এলো। আজ মহাবীর এচিলীস যুদ্ধে যাবেন–আর ভয় নেই। আজ গ্রিক সৈন্যের জয়!
ওদেসিজ ও দায়য়ামীদাস খোঁড়াতে খোঁড়াতে (কারণ এখনো তাদের আহত স্থানগুলিতে বেদনা ছিল) বীরবর এচিলীসের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এগামেমননও নতমাথায় তাঁদের পেছনে পেছনে এচিলীসের কাছে এলেন। মন তার চিন্তায় ও বেদনার
ভারে অবসন্ন। এগামেমননকে দেখে এচিলীস হাত বাড়িয়ে তার সঙ্গে মোসাফা করলেন। . অতঃপর সকলকে শুনিয়ে বললেন–বন্ধু এগামেমনন, আমার প্রিয় গ্রিক বীরগণ, কি কুক্ষণে বালিকা ব্রীসাসকে নিয়ে আমাদের ঝগড়া বেধেছিল, তার ফলে আজ শত শত গ্রিক প্রাণ দিয়েছে। যদি আমি এমন করে রাগ করে বসে না থাকতাম, তা হলে শত্রু সৈন্যের এতটা বাড়াবাড়ি সম্ভব হতো না। আজ দেশের জন্যে, গ্রিক জাতির সম্মান ও মঙ্গলের জন্যে, আমার মনের সমস্ত গ্রনি দূর করে এগামেমননকে বন্ধু বলে গ্রহণ করছি।
এগামেমনন এচিলীসকে বললেন–যেদিন থেকে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেছি, সেদিন থেকে আমার মনস্তাপের সীমা নেই। তোমার ব্রীসাসকে তুমি নাও, আর আমার যদি কোনো অপরাধ থাকে, ক্ষমা কর।
অতঃপর দুই বন্ধুতে কোলাকুলি হল বালিকা ব্রীসাস এতদিন পর এচিলীসের ঘরে ঢুকে আজিজের দেহের পার্শ্বে বসে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। প্রতি ঊষাকালে আজিজ এচিলীসের সঙ্গে নাস্তা করেছেন, একসঙ্গে বেড়িয়েছেন, একসঙ্গে থেকেছেন। তাঁর পতনে যে ব্রীসাসের মনে খেদ হবে সে আর আশ্চর্য কী! আজিজ বড় ভালো লোক–বেঁচে থাকতে তিনি ব্রীসাসকে বড়ই ভালবাসতেন। ব্রীসাসের সঙ্গে তার সখীরাও চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
কিছু নাস্তা করেই গ্রিক বীরেরা যুদ্ধ ময়দানে নামলেন। আজকের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে লেখনী অসমর্থ, এমন ভীষণ যুদ্ধ কোনো দিন হয় নি, হবেও না।
রাজা প্রিয়ামের এক ছেলে সৈন্যদের সম্মুখবর্তী হয়ে এচিলীসকে আক্রমণ করল। যার সামনে পাহাড় পর্যন্ত কাঁপে, তার সামনে এই ক্ষুদ্র ছেলের দাঁড়ানোটাই আশ্চর্যজনক। একটু আস্ফালন করেই সে পালিয়ে গেল।
যে এচিলীসের সামনে পড়েছিল–সে-ই প্রাণ হারাচ্ছিল। অনবরত দুই হাত দিয়ে। শত্রু-সৈন্য কেটে কেটে এচিলীস ত্রয় নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। রাজা প্রিয়ামের আর এক ছেলে এচিলীসের সম্মুখে পড়তেই সে প্রাণ হারালো। একবার এই সময়ে হেক্তর এচিলীসের সামনে পড়েছিলেন, পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন। এচিলীসও গ্রাহ্য করলেন না–এত শীঘ্র তিনি হেক্তরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক না।
জয় সৈন্যেরা হটতে হটতে নগরের নদীর কাছে এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো। এচিলীস ক্রমেই তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে কোনো কোনো সৈন্য নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, কেউ বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেবার জন্যে এদিক ওদিক ছুটতে লাগলো। তাদের অনেকে মনে করে ছিল ক্লান্ত এচিলীস নগরের এত নিকটে আসতে কখনও সাহস পাবেন না। কিন্তু যখন তিনি একেবারেই নিকটে এসে উপস্থিত হলেন, তখন নগরের খোলা দুয়ার দিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো।