আজিজের দেহ ফেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনেলাস নিজের দলের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করলেন। পথে বীরবর আজাককে দেখতে পেয়ে আজিজের মরণ সংবাদ দিলেন।
এদিকে হেক্তর আজিজের দেহ হতে লোহার পোশাক খুলে ফেল্লেন। কতকগুলি গ্রিক সৈন্য এসে নূতন করে তাঁকে আক্রমণ করলে। হেক্তর মরা আজিজকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তার সঙ্গীরা তাঁকে কাপুরুষ ও ভীরু বলে গালি দিল। তাড়াতাড়ি নিজের পোশাকটি ফেলে এচিলীসের পোশাক–যেটি তিনি এখনি আজিজের গা থেকে খসিয়ে নিয়েছেন, সেইটি পরে নিয়ে ফিলে দাঁড়ালেন। এই পোশাকটি ভারি মূল্যবান, এচিলীসের বাবা বিয়ের দিন তাঁর পরী-শ্বশুরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই পোশাক গায়ে দিলে দেহে হাজার হস্তীর শক্তি আসে, সামনে কোনো শত্রু দাঁড়াতে পারে না।
যাই হোক, হেক্তর ফিরে দাঁড়ায়ে আবার আজিজের মরা শরীরটির কাছে গেলেন, গ্রিক সৈন্যও হেকতরে সেখানে একটা ভয়ানক যুদ্ধ লাগলো। বীরগণ একবার সামনের দিকে এগিয়ে একবার পেছন দিকে পিছিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন।
এচিলীস জাহাজের উপর থেকে আবার এই যুদ্ধটি দেখছিলেন। তিরি শঙ্কিত হয়ে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন–খোদা, আমার প্রিয় বন্ধু আজিজের কোনো বিপদ হল না তো? আমি যে তাকে জাহাজ ছেড়ে মাটিতে নামতে নিষেধ করেছিলাম। যদি সে আমার কথা না শুনে থাকে, তা হলে সর্বনাশ হয়েছে।
এমন সময় জনৈক সৈন্য কাঁদতে কাঁদতে এসে এচিলীসকে বলে–হে বীর আপনার বন্ধু আজিজের পতন হয়েছে, গ্রিক সৈন্যের অবস্থা শোচনীয়, বিপক্ষের সামনে তারা কিছুতেই টিকতে পাচ্ছে না। আপনার পোশাকও শত্রু-সৈন্যের হাতে পড়েছে। বহু চেষ্টা করেও সেটির উদ্ধার করতে পারা যায় নি।
এচিলীস উচ্চৈঃস্বরে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। পাছে এচিলীস অতি দুঃখে আত্মহত্যা করেন, এই ভয়ে সৈন্যটি এটিলীসের হাত জড়িয়ে ধরলো। সন্তানের গভীর শোকে বিচলিত হয়ে সহসা এচিলীসের পরী-মাতা তিতিশা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন! মা শূন্যে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে বল্লেন-বাপ, কাঁদছো কেন? এই পরাজয় গ্রিকদের অহঙ্কারের ফল–এ যে তোমারই অভিশাপ। তোমার সঙ্গে তারা কি ব্যবহার করেছে, তা। কি আমার মনে নেই?
এচিলীস মাকে দেখে কিছু শান্ত হলেন। বললেন–মা, তোমার কথা ঠিক; কিন্তু আমি যে আমার প্রাণের বন্ধুটিকে হারিয়েছি, সঙ্গে তোমার দেওয়া পোশাকটিও শত্রু-হস্তে পড়েছে। মা আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, আমি যেমন আমার বন্ধুর জন্যে শোক করছি, শীঘ্রই আমার জন্যেও তোমাকে তেমনি করে শোক করতে হবে। যে অসম্মান আমার বন্ধুর প্রতি হেক্তর করেছে, তার প্রতিশোধ যদি না নিতে পারি, তা হলে আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই নে।
মা বললেন-বাপ, তোমার অদৃষ্টে লেখা আছে যে তুমি যদি হেরকে হত্যা কর তাহলে তোমাকে মরতে হবে।
এচিলীস বললেন–মা, আমার বাঁচবার সাধ নেই, আমার বন্ধুকে নিয়ে তারা শৃগাল ককুরের আহার যোগাবে, আর আমি এখানে বসে থাকব? এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে যেয়ে এখনই আমাকে মরতে হয়, কোনো ক্ষতি নেই।
মা বললেন–তা হলে আজিকে তুমি অপেক্ষা কর। তোমার লোহার পোশাক এখন হেক্টরের গায়ে। আমি যাচ্ছি, কাল তোমার জন্য ন্তুন পোশাক আনবো, তাই পরে যুদ্ধ করবে–এই কথাগুলি বলে এচিলীসের পরী-মা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলেন।
বড় আজাক এখন আজিজের মৃতদেহের জন্যে যুদ্ধ করছিলেন। হেক্তর মৃতদেহটি পায়ের তলায় চেপে ধরে ত্ৰয় সৈন্যদিগতে অগ্রসর হতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। শকুনের দল যেমন করে মরা দেহের চার পাশে হামলা করে ঘিরে আসে, গ্রিক সৈন্যরাও তেমনি করে অজিজের মৃতদেহের চার পার্শ্বে ঘুরছিল।
সে সৈনিকটি এচিলীসেকে বললে–বীরবর, আপনি থাকতে গ্রিক সৈন্যেরা এমন করে অপ্রস্তুত হচ্ছে?
এচিলীস বললেন–তা আমি কী করবো, আমি যে এখন নিরস্ত্র, আমার অস্ত্র নেই, পোশাক নেই কী দিয়ে যুদ্ধ করবো? আজিজের ঢালখানি পেলেও একবার এগিয়ে দেখা যেতো, কিন্তু সেখানি সে নিজেই ব্যবহার করছে।
সৈনিক বললে–যুদ্ধ না করেন এগিয়ে দাঁড়ান; আপনাকে দেখলে সৈন্যদের মনে উৎসাহ আসবে, ত্রয় সৈন্যরাও ভয় পাবে।
এচিলীস গড় পার হয়ে খোলা যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়ালেন। তিনবার আকাশ কাঁপিয়ে তিনি গর্জন করলেন, সে বজ্র গর্জনে আকাশ কেঁপে উঠল। ত্রয় সৈন্যরাও ভয়ে আজিজের দেহ ফেলে সরে দাঁড়াল, সুযোগ পেয়ে আজিজকে একখানা ঢালের উপর তুলে দ্রুত পিছিয়ে এলো।
সূর্য তখন অস্তমিত হচ্ছিল। আজিজকে দেখে এচিলীস কাঁদতে লাগলেন। প্রতিজ্ঞা করে বললেন–যাবৎ না এ মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারি, তাবৎ আমি আমার বন্ধুকে মাটি দেবো না।
ত্রয়বাসীরা সে রাত্রে যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকবে, না নগরে ফিরে যাবে ভাবতে লাগলো। হেক্তর বললেন–নগরে ফিরে আর কাজ নেই। অতি প্রত্যুষেই শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে।
তখনও রাত্রি ছিল, এচিলীস বাইরে এসে মায়ের অপেক্ষায় সমুদ্রের দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ মা পুত্রের জন্য একটি পোশাক ও একখানা নূতন ঢাল নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন। এচিলীস মাকে সালাম করে বিপুল আনন্দে ঢাল ও পোশাক তুলে নিয়ে বললেন–মা, তোমার ছেলেকে দোয়া কর, আজ হয় মৃত্যু নয় জয়।
পোশাকটি রাত্রির মধ্যেই তৈরি হয়েছিল। ঢালে আকাশ, চাঁদ, সূর্য ও তারামণ্ডলীর চিত্র আঁকা ছিল।