এমন সময় আজিজ এচিলীসের লোহার পোশাকটি পরে সেখানে উপস্থিত হলেন। এর মধ্যে সৈন্যরা একখানা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আজিজের পোশাক হতে সূর্যের রশ্মি বের হচ্ছিল, ত্রয় বাসীরা সহসা থমকে দাঁড়ালো। গ্রিক সৈন্যরাও বিপুল সাহসে এগিয়ে গেল। আজিজ অসি চালনে শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করে দিতে লাগলেন–বন্ধুর পোশাক পরে আজিজের গায়ে কোথা হতে যেন দৈত্যের বল এলো। হের শঙ্কিত হলেন; কারণ তাঁর বিশ্বাস, এচিলীসের সামনে টিকে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মার মার কাট কাট শব্দে গ্রিক বীরেরা ত্রয় সৈন্যগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ত্রয় সৈন্যগণ তেজ-বীরত্বে গড় ও পাঁচিল পার হয়ে এসেছিল, এইবার কাপুরুষের মতো দ্রুত পেছনে হটতে লাগল। হেক্তর এক প্রাচীরের ওধারে যেয়ে গড়ের ভিতর নেমে পড়লেন। এচিলীসের বন্ধু যাকে সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই যমের বাড়ি পাঠাচ্ছিলেন। হেরকে পালাতে দেখে তার দিকে ছুটলেন, কিন্তু তাকে ধরা গেল না। রক্ত আর মরা মানুষের স্থূপে আজিজের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঝড়ের বাতাসের মতো গ্রিক সৈন্য ত্রয়-সৈন্যশ্রেণীর উপর যেয়ে পড়তে লাগলো। বড় গাছের উপর আঘাত করলে যেমন শব্দ হয় অথবা পাথরের উপর শাবলের কোপ দিলে যেমন আওয়াজ শোনা যায়, শত্রুশ্রেণীর লোহার আবরণের উপর তেমনি শব্দ করে গ্রিকেরা অস্ত্র চালাতে লাগলো। ত্রয় সৈন্যগণ সে তেজ সহ্য করতে পারল না–তাদের অসংখ্য সিপাই মারা গেল।
০৭. আজিজ যুদ্ধ করতে করতে
আজিজ যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিলেন, ত্রয়বাসীরা মৃত সৈন্যদের দেহ উদ্ধার করবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করছিল, কিন্তু আজিজের বিক্রমের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ান তাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।
ক্রমে আজিজ ত্রয় নগরের সিংহ দুয়ারে এসে উপস্থিত হলেন, পেছনে সংখ্যাতীত গ্রিক সৈন্য বিজয় চিৎকারে আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
সহসা আজিজ শুনতে পেলেন, কোণে একটি গায়েবী আওয়াজ, আজিজ, জয় নগরে তুমি প্রবেশ করতে পারবে না। আজিজ, থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলেন–এ কার শব্দ? এ যেন আসমান থেকে আসছে।
হেক্তর তার রথের পার্শ্বে দাঁড়িয়েছিলেন। কে যেন তার কানেও বলে গেল,–হেক্তর দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও না–এ-যে আজিজ এচিলীসের পোশাক পরে তোমাদেরকে ছলনা করছে, অবসন্ন আজিজের সঙ্গে লড়াই কর–সে তোমার হাতেই মরবে।
হের গায়েবি শব্দে চমকে উঠলেন। সারথিকে বললেন–চালাও রথ। রথ আজিজের সামনে আসা মাত্র আজিজ সারথির মাথায় এমন এক আঘাত করলেন যে বেচারা সেই আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল। হেক্তর তাঁর প্রিয় সারথির দেহ রক্ষা করবার জন্যে এক লম্ফে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে তলোয়ার নিয়ে আজিজের সামনে খাড়া হলেন–তার পর দুই বীরে লড়াই আরম্ভ হল। হেক্তর মেঘের মতো গর্জন করে সিংহের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আজিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। আজিজও সামান্য নন। হেক্তরের সমস্ত বীরত্ব আজিজের সামনে ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু তা হলে কি হয়, হেরের হাতেই আজিজের মরণ লেখা ছিল। হঠাৎ আজিজের তল পেটে হেরের তলোয়ার বসে গেল। আজিজ যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আজ এচিলীসের মাথার টুপি বীরদেহের পোশাক ধূলামাটিতে কলঙ্কিত হল–যে পোশাকের অপমান আজ পর্যন্ত কোথায়ও হয় নি।
হের আজিজের বুকের উপর বসে বলতে লাগলেন–আজিজ, কোথায় এখন বীরত্ব? তুমি জয় নগর জয় করতে চেয়েছিলে? ত্রয়-কুমারীকে গ্রিক যুবকদের দাসী করতে চেয়েছিলে? কোন্ জয় কুমারীকে পাবার আশা করেছিলে–এখন যে কাকে-চিলের খোরাক হলে?
আজিজ রুদ্ধ-কণ্ঠে বললেন–হেকতর এখন আমার অন্তিম কাল, যা বলবার বলে যাও’; কিন্তু মনে রোখো শীঘ্রই এর প্রতিফল পাবে। আমার বন্ধু এচিলীসের হাতে তোমার পরাজয় ও মরণ বাধা রয়েছে। ঠিক এই জায়গাতেই তোমার বীর-দেহের অসম্মান হবে। এই কথা বলতে বলতে অজিজ চিরন্দ্রিায় ঘুমিয়ে পড়লেন–যেন এক গোছা সদ্য-ফোঁটা ফুল গাছ থেকে কে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। আজিজ সবে মাত্র যৌবন সীমায় পা দিয়েছিলেন।
হেক্তর কুকুরের খোরাকীর জন্য অজিজের মৃতদেহকে গাড়িতে উঠিয়ে নিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ভীমবেগে মেনেলাস এসে মৃত আজিজের দেহের পাশে দাঁড়ালেন; বললেন–খবরদার, এ দেহ কেউ ছুঁতে পারবে না। গ্রিক বীরের দেহ শৃগাল কুকুরের খোরাক নয়।
হেকতরকে সরিয়ে দিয়ে গদাধর নামে এক ত্রয় পালোয়ান সামনে এসে বললে–দুষ্ট মেনেলাস, তুই না আমার ভাইকে মেরে ফেলেছিলি? আজ তার উচিত প্রতিফল পাবি–এই বলেই সেই লোকটি মেনেলাসকে আক্রমণ করলে।
মেনেলাস লোকটির ব্যবহারে নিতান্ত বিরক্ত হয়েছিলেন, এহেন ঘৃণিত আক্রমণে এরূপ ক্রুদ্ধ হলেন তা আর কি বলবো।
গদাধরের আক্রমণে মেনেলাসের কিছুই হল না। গদাধর ভেবেছিল, মেনেলাসের মাথাটা কেটে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে, তাতে মায়ের শোক অনেকটা কমতে পারে। দুদিন আগেই তার বড় ভাইকে মেনেলাস যুদ্ধক্ষেত্রে মেরে ফেলেছেন। গদাধর বিরক্ত হয়ে মেনেলাসকে আবার আঘাত করলে। মেনেলাস ভাবলেন, এই হতভাগাটিকে আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তলোয়ারখানি উঁচু করে অতি ক্ষিপ্রহস্তে গদাধরের মুখের মধ্যে চালিয়ে দিলেন। আর কি রক্ষা আছে? গদাধর মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল, হুঁ-হুঁ করে তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। দুই এক মিনিটে তার দেহ হতে প্রাণ চলে গেল। কিন্তু এতে মেনেলাসের আনন্দ করবার কিছুই ছিল না, আজিজের মৃত্যুতে তার মন দুঃখে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অতঃপর আজিজকে তিনি ঘাড়ে করে তুলে নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিশ জন ত্রয় সৈন্য তাকে ঘিরে ফেলে। মেনেলাস ভাবলেন, আজিজের দেহ উদ্ধার করতে পারবো না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রাণও যাবে।