একা ওদেসিজের পক্ষে এত গুলি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা খুব শক্তকথা। হরিণকে শিকারী কুকুরেরা যেমন করে ঘিরে ফেলে, ত্রয় সৈন্যরাও তেমনি করে ওদেসিজকে ঘিরে ফেলল। যুঝতে যুঝতে তিনিও জখম হলেন। ঊরু হতে দর দর করে রক্ত পড়তে লাগলো। বহুদূরে বড় আজাক ও মেনেলাস ছিলেন–ওদেসিজ চীৎকার করে ডেকে বললেন–একবার এদিকে এস, একা আর পারছি নে, আমার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। মেনেলাস আর আজাক তীরবেগে ছুটে এসে ওদেসিজের লুণ্ঠিত দেহ কাঁধে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। পরাজিত গ্রিক সৈন্যশ্রেণীও ক্রমশ হটে আসছিল–শেষে যে যেমন পারল, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে সমুদ্রকূলে শিরিরের দিকে ছুটতে লাগল।
তোমাদের মনে আছে, আগোমেমনন কর্তৃক আপমানিত হয়ে বীর এচিলীস ভয়ানক মনঃকষ্টে যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে জাহাজে বসেছিলেন। জাহাজের মাস্তুলের উপর বসে রোজই তিনি যুদ্ধ দেখতেন। আজও দেখছিলেন। গ্রিক সৈন্য প্রাণ ভয়ে ত্রয় সৈন্য শ্রেণীর সম্মুখ হতে পলায়ন করছে, সমস্ত বীর আহত হয়ে এক এক করে যুদ্ধময়দান ত্যাগ করছে–এ সবই আজ তিনি দেখছেন। জন্মভূমির এই দারুণ অপমানে মন তাঁর ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এগামেমননের দুর্ব্যবহারের কথা মনে হয়ে তার মনে আরো দুঃখ হচ্ছিল। তিনি আপন মনে বলতে লাগলেন–এগামেমনন, তোমার অহঙ্কারের জন্যেই গ্রিকবাসীদের আজ এই অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই খোদার অভিশাপ তোমাদের উপর পড়েছে, নইলে যা কখনও হয় নি তাই আজ হল। এ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে গ্রিক সৈন্য পিঠ দেখায় নি। যাক আমার কী? তোমরা তো আমায় বাদ দিয়েছ, আমি তোমাদের কেউ নই।
কিন্তু তবুও তার মন মানল না। সৈন্যদের অবস্থা জানবার জন্যে বন্ধু আজিজকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন–কে কেমন আছে, যুদ্ধের অবস্থা কিরূপ ভালো করে শুনে এস।
আজিজ এসে দেখলেন–নেস্তর পেঁয়াজ গোস্ত খাচ্ছেন। তার পার্শ্বে গ্রিক সৈন্যদের চিকিৎসক আহত হয়ে পড়ে আছেন। নেস্তর আজিজকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর?
আজিজ বললেন–আপনাদের অবস্থা জানবার জন্যে এচিলীস আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।
নেস্তের বললেন–আমরা মরি আর বাঁচি তাতে এচিলীসের কী? এচিলীস আপন মনে রাগ করে বসে আছেন। আমাদের জন্যে কি তার মমতা আছে?–কথাগুলি নেস্তর খুব দুঃখের সঙ্গেই বললেন।
নেস্তর আবার বললেন–ইদীয়মেনাস, ওদেসিজ, এগামেমনন, সবাই আহত হয়েছে। চিকিৎসক স্বয়ং তীরের আঘাতে মৃতপ্রায়। এখন বল, কী করি? ত্ৰয় সৈন্য ক্রমশ তাড়া করে জাহাজের দিকে আসছে। এখনও গড় পার হয় নি–সে চেষ্টাও তারা করবে। তুমি দৌড়ে গিয়ে এচিলীসকে আমাদের শোচনীয় অবস্থার কথা বল। তিনি যদি যুদ্ধে না নামেন, তবে অন্তত তার লোহার পোশাকটি যেন দেন। তুমি সেই পোশাক পরে যদি হয় সৈন্যের সামনে দাঁড়াও তাহলে তারা ভয়ে পালাবে, গ্রিক সৈন্যদের বুকের যথেষ্ট বল আসবে।
আজিজ দেরি না করে সকল কথা জানাবার জন্যে বন্ধুর জাহাজের দিকে গেলেন।
এদিকে গ্রিকদের তৈরি গড়ের ধারে সারি সারি ত্রয় সৈন্য দাঁড়াল, গড় পার হবার চেষ্টা তারা করছিল। হেকতর সৈন্যদেরকে বললেন–বীরগণ, একদিন তো মরতে হবেই, আজ মানুষের মতো মর। অসম্মানের জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী?
অবিলম্বে ত্রয় সৈন্য লাফিয়ে সাঁতরিয়ে গড় পার হতে লাগলো। গড়ের এ ধারে দাঁড়িয়ে গ্রীক সৈন্যেরা অনবরত তীর নিক্ষেপ করছিলো, কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। ত্রয় সৈন্য
অসীম উৎসাহে গড় পার হয়ে একেবারে জাহাজ শ্রেণীর পাশে প্রাচীরের গায়ের কাছে এসে উপস্থিত হল। হেক্তর হুঙ্কার দিয়ে বললেন–ভাঙ্গ প্রাচীর, লাগাও আগুন, মার গ্রিক।
গ্রিক-সৈন্য আরও হটে যেতে বাধ্য হল! প্রাচীরের ওধারে তারা অনবরত কুড়োল দিয়ে শত্রুসৈন্যদের মাথা কাটতে আরম্ভ করলো। কিন্তু তবুও তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
ক্রয় সৈন্য প্রাচীর ভেঙ্গে এইবার একেবারে জাহাজের নিকেটে এসে উপস্থিত হল। গ্রিকেরা শৃগালের মতো দৌড়ে একেবারে জাহাজে উঠে পড়লো।
হের উচ্চৈঃস্বরে গ্রিকদিগকে বললে–হে শৃগালের দল, পৃথিবীর আলো ছেড়ে এইবার গর্তের মধ্যে পালাচ্ছ। তার পরে নিজের সৈন্যদলকে বল্লেন–তোমরা ক্ষান্ত হয়ো না। গর্ত হতে তাদের লেজ ধরে টেনে বের কর, জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারতে হবে।
হেক্টর ভীষণ আগুন তৈরি করবার জন্যে হুকুম দিলেন।
এচিলীস এখনও নিশ্চেষ্ট ছিলেন। তিনি দেখতে লাগলেন, জাহাজে আগুন ধরবার জন্যে হেক্ক্তর সৈন্যদের হুকুম দিচ্ছেন।
এই সময় আজিজ এচিলীসকে হাত জোড় করে বল্লেন–বীরবর, এখনও কি রাগ মেটে নি? সবই যে ধ্বংস হয়ে গেল!
এচিলীস বল্লেন–হোক সব ধ্বংস তাতে আমার কী? তুমি নিশ্চিত থাক আমার জাহাজের কাছে কেউ আসবে না, আমার নির্বিবাদে পাল তুলে বাড়ি ফিরে যেতে পারব।
আজিজ–তুমি নিজে না কর, তোমার পোশাকটি আমায় দাও।আমি একবার দেখি।
এচিলীস–এই দুঃখের ভিতরেও আমাকে হাসালে! আচ্ছা, যাও আমার পোশাক নিয়ে। যদি পার, তবে ত্রয় সৈন্যগণকে তাড়িয়ে দাও; কিন্তু খবরদার নিচে নেমে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না।
এদিকে বীরবর আজাক শেষ পর্যন্ত হয় সৈন্যগণকে বাধা দিচ্ছিলেন কিন্তু আর সম্ভব হচ্ছিল না, তার শিথিল মুষ্টি হতে তলোয়ার খসে পড়ছিল।