দায়োমিদাসের কথা শুনে কয়েকজন বললে–আমরা যাবো। এদের মধ্যে ওদেসিজও ছিলেন। দায়োমিদাস ওদেসিজকেও সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করলেন কারণ ওদেসিজ যেমন বীর তেমনি তার বুদ্ধি বেশি।
তার পর দুই বন্ধু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শত্ৰুদলের দিকে আস্তে আস্তে পা ফেলে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন।
শক্রদলের নিকটবর্তী হলে তাঁরা দেখতে পেলেন, একটি লোক অন্ধকারে হেঁটে আসছে। দায়োমিদাস ওদেসিজের গা চেপে মৃদুকণ্ঠে বললেন–দেখতে পাচ্ছ লোকটিকে?
ওদেসিজ–হ্যাঁ আস্তে–ও আমাদের সৈন্য-দলের দিকে যাচ্ছে–নিশ্চয়ই ও হেরের গুপ্তচর। দায়ে এখন কী করা যায়? তীর ছুঁড়বো?
ওদে–না, সবুর কর। মারাবার আগে ওর কাছ। থকে কিছু আদায় করতে হবে। চল, ওর পিছনে পিছনে যাওয়া যাক, আমাদের সীমানার মধ্যে গেলেই ওকে পাকড়াও করবো, আর তার পর যা করবার আছে, করবো।
লোকটি নিঃসন্দেহে অগ্রসর হচ্ছিল, চোরের উপর যে বাটপাড়ি হচ্ছে, তা সে বুঝতে পারে নি।
গ্রিক সীমানায় পা দেওয়া মাত্র কে বজ্রগম্ভীর জিজ্ঞাসা করলেন–কে?
লোকটি ভীত-চকিত হয়ে এদিক ওদিক চাইতেই ব্যাঘ্র যেমন মেষকে ধরে তেমনি করে দুই বীর লাফিয়ে এসে লোকটির গলা চেপে ধরলেন। সে বাধা দেবার বিন্দুমাত্র সময় পেলো না।
কাদ কাদ হয়ে সে বললে–আমাকে দয়া করে প্রাণে মারবেন না। আমার কোনো দোষ নেই। হেক্তর অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে আমাকে এই কাজ করতে পাঠিয়েছেন।
ওদেসিজ তার ঘাড়ে একটা নাড়া দিয়া বললেন–ঠিক ঠিক উত্তর দাও, তা হলে বেঁচে যাবে। শত্রুরা কোথায় কি ভাবে আছে সব বল। কেন এখানে এসেছ? লোকটি বললে নিতান্ত বেসামাল হয়ে তারা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আপনারা যদি এখন তাদেরকে আক্রমণ করেন, তা হলে তারা কুকুরের মতো পালাবে। একটা প্রকাণ্ড আগুনের কুণ্ডুর দিকে হাত উঠিয়ে বললে, ঐ ওখানে হেত্তর শুয়ে আছে। থেবসের রাজা এসেছে, সেও সেখানে আছে। তার সোনার সাজপরা ঘোড়াগুলিও বাইরে বাধা আছে। ওদেসিজ বললেন–দুর্বৃত্ত, প্রাণের মায়ায় স্বজাতির সর্বনাশ করতে অগ্রসর হয়েছ? তোমার জীবনের জন্য সহস্র লোকের মৃত্যু কামনা করছ। ধর, তোমার উপযুক্ত শাস্তি গ্রহণ কর। এই কথা বলে ওদেসিজ হতভাগ্যের গলায় তলোয়ার বসিয়ে দিলেন। স্থানটি রক্তে রক্তময় হয়ে গেল।
তার পর তাঁরা ধীরে ধীরে খুব সতর্ক ভাবে পা ফেলে থেবসের রাজা আর সেই সোনার সাজপরা ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়েছিল সেখানে উপস্থিত হলেন। অঘোরে মহাসুখে তারা নিদ্রা যাচ্ছিল। প্রহরীরাও ঘুমে কাতর হয়ে মাথা ঢুলোচ্ছিল।
ওদেসীজ বললেন–এই দুটি প্রহরীকে আগে শেষ করে ফেলি। এই কথা বলেই একটুও দেরি না করেই ওদেসিজ তাদের ঘাড়ের উপরে পড়ে দেহ হতে মাথা ছিঁড়ে ফেললেন।
দায়োমিদাসও প্রায় বার জন লোককে মেরে ফেললেন।
দায়োমিদাস বললেন–ওদেসিজ এইবার সরে পড়া যাক। এখনও কেউ জাগে নি, জাগলে সর্বনাশ হবে। আস্তে আস্তে ঘোড়াগুলিকে সরিয়ে ফেল।
ওদেসিজ আর দেরি করলেন না। গোড়াগুলো লাগাম ধরে বের করে আনলেন। তারপর দুজনে দুটির পিঠে চড়ে ঘোড়াগুলো নিয়ে দিলেন ছুট।
প্রাতঃকালে নেস্তর তাঁর তাঁবুর সামনে দেখলেন–ওদেসিজ, দায়োমিদাস আর একপাল ঘোড়া। নেস্তর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–এ কী? এ ঘোড়া তো জীবনে দেখি নি! কোথা হতে এগুলি এনেছ? জীবনে বেঁচে এসেছ, তাই কত–এর ওপর ঘোড়াগুলি কোথা থেকে এল? এ ঘোড়া তো যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না?
ওদেসিজ বললেন-থেবসের লোকেরা প্রিয়াম রাজার সঙ্গে যোগ দিয়েছে, যুদ্ধে স্বয়ং তাদের রাজা এসেছেন। এসব তাঁরই ঘোড়া, আমরা অনেক রাত্রে তাদের অনেক লোককে মেরে ফেলে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে এসেছি।
নেস্তর আনন্দে বললেন–ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
দায়োমিদাস বললেন–বিপক্ষেরা এখনই যুদ্ধে নামবে, এ শয়তানী তারা সহ্য করবে। অতএব আনন্দ করবার সময় নেই, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
এগামেমনন ও আর আর বীরগণ ওদেসিজ ও দায়োমিদাসকে সাদর সংবর্ধনা করলেন, অতঃপর বিশ্রামের পর সিঙ্গা, ঢোল ও অন্যান্য বাদ্য বাজিয়ে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।
অসংখ্য গ্রিক সৈন্য কাতারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকূল হতে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ওদিক থেকে ত্রয়-সৈন্যও এগিয়ে এল। তার পর ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হল।
তীর, বর্শা ও তলোয়ারের হানাহানি সমানে চলতে লাগল-ধীরে ধীরে সৈন্যে সৈন্যে মারামারি কাটাকাটি শুরু হল। বাপরে, সে কী ভয়ানক ব্যাপার! কত কাটা মাথা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, কার ঘোড়া মাটিতে শুয়ে পড়ল, কত সওয়ার তীরের আঘাতে প্রাণ দিল।
আজ এগামেমনন ভয়ঙ্কর বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছেন। শত শত মানুষকে তিনি কেটে ফেলে দিলেন, তবুও তার লড়াইয়ের তৃপ্তি মিটছে না। অনবরত আগুনের তুবড়ীর মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগলেন। শেষকালে হঠাৎ তীর এসে তার পাশে লাগল, রক্তাক্ত দেহে তিনি ময়দান হতে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।
এইবার হেক্টর বীর-বিক্রমে গ্রিক সৈন্যের সম্মুখীন হলেন। সারারাত্রি জেগে দায়োমিদাস ও ওদেসিজ খুব শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তবুও তারা ভয়ানকভাবে যুদ্ধ করছিলেন।
দায়োমিদাস হেৰ্তরের মাথায় এমন একটা ভয়ানক আঘাত করলেন যে, হেকতর চোখে সরষে ফুল দেখলেন। দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে কষ্টকর হল। এমন সময় পেরিস। দায়োমিদাসের হাতখানা গুলতি ছুঁড়ে ভেঙ্গে দিলেন। দায়োমিদাস বেদনায় অস্থির হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। বীরদের মধ্যে একা ওদেসিজ রইলেন।