নগরের লোকগুলিকে আবার উপাসনা করতে বলে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটলেন।
তখন বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। সৈন্যরা সারাদিন যুদ্ধ করে হয়রান হয়ে পড়েছে। শত্রু সৈন্যের সম্মুখীন হয়ে হেক্তর বললেন–হে গ্রিক সেনানী। দুর্বল সৈন্যদলকে বিশ্রাম করতে দাও। আজকার মতো যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে। এখন তোমাদের কোনো বীরকে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে দাও। এখন হাতিতে হাতিতে লড়াই হোক পিঁপড়ে দলের কামড়া-কামড়ি দেখে আর কাজ নেই! কে আছ, এগোও দেখি। হেকতর
আজ একা যুদ্ধ করে গ্রিসের যুদ্ধসাধ মিটাবে।
বৃদ্ধ নেস্তর গর্জে উঠে বললেন, কী, এত বড় কথা! এখনও গ্রিসের কোনো বীর দুর্বৃত্তকে শিক্ষা দেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে না? কী বলবো! যদি যৌবনের তরল রক্ত আজ আমার বাহুতে থাকতো, তা হলে এতক্ষণে হেতরের মাথা দেহের সঙ্গে থাকতো না! নেস্তরের দাপটে একদিন পাহাড় কেঁপেছে। আজ আমি অকর্মণ্য বলে কি সকলেই অকর্মণ্য?
সঙ্গে সঙ্গে নয়জন বীর লাফিয়ে উঠে বললেন–আমি হেরের সঙ্গে যুদ্ধ করবো!
বাহুতে কে কত বল ধরে তা দেখাবো। এচিলীস যুদ্ধক্ষেত্রে নেই বলে কি এখানে আর কোনো বীর নেই।
নয় জনের সঙ্গে একা হেকতরের তো যুদ্ধ হবে না।
নয় জনই শূন্যে তলোয়ার ছুঁড়ে বললেন–যার তলোয়ার সকলের উপরে উঠবে, সেই যুদ্ধে যাবে। বীরবর বড় আজাকের বৃহৎ তলোয়ার ভো ভো করে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। হের ঊর্ধ্বে সেই ভীষণ তলোয়ারের ঘূর্ণমান চক্র দেখে একবার কেঁপে উঠলেন। বীর আজাকই জয়ী হলেন। গ্রিক সৈন্যেরা জয়ধ্বনি করে উঠলো।
এগামেমনন বললেন–বীরশ্রেষ্ঠ আজাক, হেৰ্তরের দর্প চূর্ণ করবার জন্যে তুমিই উপযুক্ত।
অদূরে হেকতর ক্রুদ্ধ ব্যাঘের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। আজাক একবার তার দিকে চেয়ে দেখলেন উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ড তাঁর ঘন ঘন কাঁপছিল।
তার পর সেই ভীষণ চেহারা আজাক ঘোড়ায় চড়লেন। মুহূর্তের জন্য কেন যে হেকতরের প্রাণ কেঁপে উঠলো। উভয় দলের সৈন্যগণ এই দুই মহাবীরের জীবন-মরণ লড়াইয়ের দিকে চেয়ে রইল।
হেকতরের উন্নত বিশাল বক্ষ, তার দীর্ঘ কঠিন বাহু, শক্তিশালী অশ্ব সেই রণভূমির বালুকণার প্রাণে পর্যন্ত ভয়ের সঞ্চার করছিল। মহাবীর আজাক এহেন বীরকে তুণের সমান জ্ঞান করলেন। যখন তিনি পাহাড়ের মতো উঁচু মাথায় হেকতরের সম্মুখীন হলেন তখন গ্রিক সৈন্যদের প্রাণ জয়োল্লাসে নৃত্য করতে লাগলো। কারণ ত্রয়বাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হেকতর যদি হেরে যায়, তা হলে দুদিনেই ত্রয় নগর ধ্বংস করে হেলেনকে উদ্ধার করা যাবে।
হেকতর আজাকের পানে তার বর্শা নিক্ষেপ করলেন। পাহাড়ের গায়ে মাটির দলার যেমন দূরবস্থা হয়, হেরের বর্শাও তেমনি অবস্থা হল। সে কী ভীষণ আঘাত! বুকের উপরকার লোহার চাঁদর ভেদ করে হাড়ে যেয়ে লাগতো, যদি না হেক্তর মুহূর্তের মধ্যে উপুড় হয়ে বর্শা বেগকে একটু কমিয়ে দিতেন।
দুই হিংস্র ব্যাঘের মধ্যে যেমন করে লড়াই হয়, হেক্টর ও আজাকের তেমনি লড়াই। চলতে লাগলো। একখানি প্রকাণ্ড পাথর তুলে হেক্তর আজাকের উপর ছুঁড়ে ফেল্লেন, কিন্তু আজাকের তাতে কিছুই হল না। আজাকও প্রতিশোধ নেবার জন্য ততোধিক বড় একখানা পাথর নিয়ে হেকতরের মাথা সোজা নিক্ষেপ করলেন, কপালগুণে পাথরখানি হেকৰ্তরের হাঁটুতে যেয়ে লেগেছিল, নইলে তখনই তাকে যমের বাড়ি যেতে হতো।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। উভয় বীর তলোয়ার নিয়ে যুঝতে যাচ্ছিলেন এমন সময় উভয় পক্ষের সৈন্যগণ চিৎকার করে বল্লে–সাবাস! সাবাস! কিন্তু আর নয়! আজকের মতো এই পর্যন্ত থাক। আঁধার হয়ে এসেছে। আজাক বল্লেন–হের প্রথমে আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করেছে, যুদ্ধ স্থগিত রাখবার জন্যে প্রথমে তারই প্রস্তাব করা উচিত।
হেক্তর বল্লেন–আজাক, আপনার বীরত্বে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, আসুন, আজ আমরা যুদ্ধে ক্ষান্ত দি। জাতির জন্যে যুদ্ধ করতে এসেছি সুতরাং আপনাতে আমাতে কোনোই শত্রুতা নেই। বন্ধুরূপেই আজকের মতো আমরা বিদায় নিই। তার পর আর এক শুভদিনে আমাদের পরস্পরের বল পরীক্ষা হবে।
আজাক বল্লেন–বেশ।
অতঃপর উভয়ে উভয়ের নিকট থেকে বিদায় নিলেন! আজাক হেরকে একটা সোনার কোমরবন্ধ উপহার দিলেন, হেরও আজাককে একখানা তলোয়ার দিলেন।
সে রাত্রিতে সমস্ত গ্রিক সৈন্য আজাককে নিয়ে আমোদ উৎসবে কাটিয়ে দিল।
০৬. পরের দিনও ভয়ানক যুদ্ধ হল
পরের দিনও ভয়ানক যুদ্ধ হল। ত্রয়-সৈন্যরা গ্রিক সৈন্যদেরকে একেবারে সমুদ্রতীরে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। নেস্তর, ওদেসিজ প্রভৃতি বীরগণ বড় অস্থির ও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
এয়বাসীরা সারা রাত্রি ধরে ময়দানে বসে আগুন জালিয়ে কাটাল, পরদিন গ্রিকদিগকে একেবারে সাফ করে ফেলবে, এই তাদের উদ্দেশ্য। জয়ের আনন্দ তাদিগকে একেবারে পাগল করে তুলেছিল।
এদিকে গ্রিকেরা রাত্রিকালে এক সভা করলেন। অবস্থা তো খুবই শোচনীয়, কাল কী ভাবে শত্রুদলকে বাধা দিতে হবে, তারই জল্পনা-কল্পনা চালাতে লাগল।
নেস্তর বললেন–শত্রুরা এখন কী করছে, তার সংবাদ নেওয়া দরকার। কিন্তু কে প্রাণ হাতে করে এই দুঃসাহসের কাজ করবে? শক্রদলের কাছ দিয়ে যাতায়াত করলে হয়তো জীবন দিতে হবে।
দায়োমিদাস বললেন–এ কাজ আমি করব, কিন্তু আমার সঙ্গে আরও একটি লোক চাই!