১ম–চাকরি কি ভালো কাজ নয়?
২য়–কোনো জিনিসের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। সকলের পক্ষেও চাকরী খারাপ নয় যেখানে আত্মসম্মান বজায় থাকে না, চরিত্র ঠিক থাকে না, আপনা-আপনি পাপ ও মন্দজীবনের সংস্পর্শ ঘটে ওঠে, যেখানে সর্বদাই দূর দূর, ছেই ছেই ভাব, সেখানে চাকরী না করাই ভালো। চাকরী গ্রহণ করে প্রবুর সঙ্গে ঝগড়া-কলহ, তার মঙ্গল চেষ্টা না করা, প্রভুর অভদ্র ব্যবহার–এসবও ভদ্রলোকের কাজ নয়। চাকরিতে আয়-উন্নতি কম; ব্যবসা করতে পারলে তাতেই সুবিধা।
১ম–যারা চাকরি করে, তাদের কি সম্মান বেশি
২য়–দাস ও গোলাম জাতি আমরা। যে ঘাড় ধরতে পারে, দুকথা চড়া বলতে পারে, তারই সম্মান বেশি। স্বাধীন জীবন, ব্যবসায়ীর জীবুন এ যেন তুচ্ছ, না পাবার যোগ্য নয়–এমন ধারাই ভাব। তা বলে আর কি হবে, যা ভালো তাই করা উচিত। কালে কালে দেশে লোকের মন উন্নত হলে লোকে স্বাধীনতাকেই বেশি ভালো তাই করা উচিত। কালে কালে দেশের লোকের মন উন্নত হলে লোকে স্বাধীনতাকেই বেশি ভালোবাসবে। ইউরোপেও সাধারণ লোকদের মাঝে চাকুরের সম্মান কম নয়, কিন্তু দেশের সাধারণ স্বাধীন অধিবাসী অবহেলা ও লাঞ্ছনার পাত্র নয়। চকুরেরা ও দেশের শাসন-যন্ত্র দেশবাসীর টাকাতেই বাঁচে। চাকুরেরা এদেরই চাকর।
.
পরিবার
২য়–যে পরিবারে সহানুভূতি নেই–সে পরিবার মর্যাদা দাবি করতে পারে না–সে পরিবারই নয়।
১ম–এরূপ কি সম্ভব?
২য়–এরূপ পরিবার অনেক আছে। হয়ত বড়ির একটি লোক রোগ যন্ত্রণায় চীৎকার করছেন, অবহেলায় তার কষ্টের সীমা নাই। তাকে কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করে না। তিনি যখন সুস্থ হবে, তখন সকলেরই পরম আত্মীয়। মা পীড়িতা, রোগশয্যায় নিঃসহায় হয়ে পড়ে আছেন, বাড়ির সবাই হাসি-খেলায় ব্যস্ত। ছেলেদের আনন্দ উৎসব সমানভবেই চলছে। পত্নী পীড়িতা-স্বামী তাকে একবারও ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন না-এ আদর্শ পরিবারের ভালো নয়।
১ম–বাস্তবিক এ বড়ই অন্যায়।
২য়–সহানুভূতি ব্যতীত আত্মীয়তার কোনো মূল্য নেই। যে মাতা সমস্ত রাত্রি জেগে সন্তানকে মানুষ করেছেন, তার সামান্য অসুখে অস্থির ও ব্যাকুল হয়েছেন, রোগপীড়িতা হলে তাকে কেউ দেখার নাই। কি অবিচারের কথা। বস্তুত মনুষ্য পশুর চেয়েও অধম এবং অতিশয় অকৃতজ্ঞ। মনুষ্য রোজা-নামাজ করে, কিন্তু তার জীবনের কাজ পশুর মতো। এক ব্যক্তি সম্বন্ধে জানি, সে শুক্রবারে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিল। এদিকে তার মা ঘরে কলেরায় মরে আছেন। তাঁর যে কোনো অসুখ হয়েছে এ খবর কেউ রাখে না। বাড়িতে বধূরাও ছিলেন। যেসব সন্তানকে প্রাণ দিয়ে এই মা মানুষ করেছিলেন, এরা তাদেরই বউ। কিন্তু তাদের ব্যবহারটা দেখ। মায়ের এই অবস্থায় পুত্রেরা নামাজ পড়তে গিয়ে যদি মায়ের সেবা করতেন, তাহলে খোদা বেশি.সন্তুষ্ট হতেন।
১ম–সত্য
২য়–এক বাড়ির একটি অন্তঃসত্ত্বা বালিকা ১৮ দিন বেদনায় কাতর থেকে অবশেষে প্রাণত্যাগ করে। এরাও আবার মানুষ,-এক পরিবারের মানুষ।
১ম–মেয়েটির কি কেউ ছিল না?
২য়–ছিল বই কি? বাপ, ভাই, স্বামী সবই ছিল। লোকে বলে আপন হতে পর ভালো, ঘর হতে জঙ্গল ভালো। মানুষ আত্মীয় হয়ে যে অবিচার করে, অন্যে তা করতে ভয় পায়। পরিবারের সবাই ১৮ দিন ধরে বালিকাটির আর্তনাদ শুনলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই করলো না। এই তো আমাদের আত্মীয়তা ও পরিবারের বন্ধন। পিতা ছিলেন, স্বামী ছিল। মুসলমান পরিবারের নিরীহ নির্ভরশীলদের উপর যত অবিচার হয়–এমন আর কোথাও হয় না। সমস্ত জাতিটা যেন প্রেমহীন মনুষ্যত্ব-বর্জিত হয়ে পড়েছে। বাড়ির বুড়ো পিতা পীড়িত হলে অনেক সময় তাকে অবহেলায় মারা যেতে হয়। এমন ঘটনাও আমি জানি। বস্তুত পরিবারের প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে-নইলে পরিবারের লোকদিগকে পশু বল্লে অন্যায় বলা হবে না। পীড়িতের খবর নেওয়া, সর্বপ্রকারের তার ব্যথাকে লাঘব করতে চেষ্টা করা প্রত্যেক ভদ্র পরিবারের কর্তব্য। বাড়ির মুরুব্বী যিনি, তার নির্ভরশীলদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে কৃপণতা করা উচিত নয়। কর্তার অসুখে ডাক্তার, কবিরাজ হাঁটাহাটি করছে, কিন্তু পরী বা নির্ভরশীলদের বেলায় জিজ্ঞাসা করবার লোক নাই।-এ বড়ই অন্যায়।
১ম–বাড়িতে বিধবা মেয়েদের অনেক সময় অবহেলা হয়।
২য়–তা হয় বই কি! একবার বিয়ে দিয়েছ, যেন সমস্ত কর্তব্য শেষ হয়েছে, এইরূপ মনে করা হয়। বিধবা সুখ-দুঃখের প্রতি কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয় না। –১ম–বাড়ির কর্তার বুড়ো বয়সে পত্নী মায়া যাবার ১ মাসের মধ্যে বিয়ে হয়। বিধবা মেয়েদের ৫ বৎসরের মধ্যে জুটে উঠে না–এর মানে কী?
২য়–দুঃখের কথাই বললে। বিধবা মেয়েরা আবর্জনা বিশেষ। জাতির সর্বত্র যেন গলিত পচা ঘায়ে পরিপূর্ণ। অন্যায়ে যেন এদের বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। মানুষের মনুষত্য সর্বত্রই লাঞ্ছিত হচ্ছে। বিধবা মেয়েদের যত শীঘ্র সম্ভব বিয়ে দিয়ে ফেলা উচিত।
১ম–এ কাজে কি জবরদস্তি ভালো?
২য়–এমন কোনো পুরুষ মানুষ এ পর্যন্ত আমার নজরে পড়ে নাই, যিনি পত্নী বিয়োগে চিরদিন মৃত পত্নীর কথা স্মরণ করে দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করেন নাই। মেয়েরা আপত্তি তুলতে পারেন, কতকটা লজ্জার খাতিরে। দরিদ্রা, পরাধীনা, নির্ভরশীল যারা, তাদের লজ্জা বেশি। এই লজ্জার বেদনা হতে নারীকে রক্ষা করতে হবে। বিয়েটা আর কিছু নয়, এই দুঃখপূর্ণ সংসারে একটা সুখ-দুঃখের সাথী খুঁজে নেওয়া। নারীর দুঃসহ জীবনের ভার একা বহন করতে পারা যায় না। এতে লজ্জার কিছু নাই। নারীর এই লজ্জার আর এক নাম ব্যথা। তারা যদি অশিক্ষিতা, পরমুখাপেক্ষী না হন তা হলে আর তাদের লজ্জা হয় না। কোনো ইংরাজ রমণী লজ্জার খাতিরে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে ইতস্তত করেন না। আমরা সর্বহারা নিঃসহয়া বলেই একটু বেশি সাধু, লাজুক এবং ভদ্র।