“মনুষ্য দুঃখে পড়লে হেসো না, ঠাট্টা করো না–মনুষ্য জীবন উত্থান পতন দিয়ে গড়া।
“কতকগুলি লোক আছে, কথা বলবার জন্যে তাদের গলা চুলকায়, কিন্তু বলবার নাই, যা কিছু অপ্রীতিকর কথা বলে মনুষ্যকে আঘাত করে–এটি বড় খারাপ।”
“মানুষ যখন দুঃখে পড়ে, তখন অনেক লোকই তাকে উপদেশ দিয়ে যায়। কারোর অযাচিত মুরুব্বী না হওয়া ভালো।”
“নিন্দুককেও কখনও বিশ্বাস করো না-তাকে কখনও আমল দিও না বরং মানব সমাজের শত্রু মনে কর, তারা সকল মানুষেরই নিন্দা করে।”
“বন্ধু, কখনো মিথ্যা বলো না–এটি নীচ লোকদেরই স্বভাব।”
“সস্তা জিনিস পেলেই অপ্রয়োজনীয় কিনো না–কিনো না-আপাতত যা প্রয়োজন নেই, তাও ক্রয় করো না।”
“যৌবনকালে বালক-বালিকার মনে খুবই অহঙ্কার জাগে, মানুষকে অসভ্য বলতে খুব ইচ্ছা হয়–কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করলেই আর একটা সময় আসে, যখন মনের অহঙ্কার –আর থাকে না। অহঙ্কার করে, জবরদস্তি করে কেউ বড় হতে পারে না। ঋণ পরিশোধ করতে কখনও ইতস্তত করো না-যতোই দেরি করবে, ততই অন্যায় করবে। ততই ঋণ পরিশোধ করবার ক্ষমতা কমে আসবে।”
“বন্ধু, যারা অধিক কথা বলে, তাড়াতাড়ি কথা বলে, চিন্তা না করে কথা বলে–তাদের কথা না বলাই ভালো।”
১ম বন্ধু–সংসারকে ঘরতুল্য করে তুলতে চাও না কি?
২য় বন্ধু–না, তা নয়, ব্যর্থতার ভিতর, হাসির ভিতরও বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। যারা অন্তর দিয়ে কথা না বলে, তাদের মূল্য খুব কম তাদের কথা শোনা অযথা কালক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।
.
প্রথম বন্ধুর দুঃখ
আশ্বিন মাসের প্রথম তারিখে একদিন সকালবেলা, প্রথম বন্ধুর শ্বশুর বাড়িতে একখানি নৌকা উপস্থিত হইল। খোকা করতালি দিয়া বাবার কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। আর কেহই কোনো কথা কহিল না। কেহ সম্বধনা করে না–১ম বন্ধু বাহির বাড়ির উঠোনে যাইয়া দাঁড়াইলেন এবং খোকার সহিত কথা বলিতে লাগিলেন।
প্রায় এক ঘণ্টা এইভাবে অতিবাহিত হইল। অতঃপর বড় শ্যালক মহাশয় বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া কহিলেন–শালা, কোথায় এসেছিস, যা দূর হ।
খোকা পিতার অপমানে তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
শ্যালকর কহিলেন–ভদ্র ঘরের কন্যাকে এইভাবে অপমান করে–তুমি যে ভাবে বৌ রেখেছিলে এইভাবে কেউ রাখে না। এই সময় শ্বশুর চড়া গলায় কহিলেন, এই কি ভালো মানুষের কাজি। আমার মেয়েকে এই তুমি দিবারাত্র কষ্ট দিয়েছ, তিরস্কার করেছ; শেষকালে টিকতে না পেরে চলে এসেছে। এখন উচিত তোমাকে উত্তম-মধ্যম দেওয়া।
শাশুড়ী ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন–জামাই-এর সঙ্গে তোমরা কি ব্যবহার করছো? দেখতে পাচ্ছি, তোমরা কতকগুলি ডাকাত।
১ম বন্ধু মর্মান্তিক দুঃখ পাইলেন প্রতি মুহূর্তে ইচ্ছা হইতেছিল–তাহার পত্নী দৌড়াইয়া আসিয়া তাহার এই নিদারুণ দুঃখ অনুভব করে, ভর্ৎসনার প্রত্যুত্তর দেয় এবং চিরদিনের জন্যে স্বামীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসে।
বশাশুড়ী জামাতাকে বাড়ির মধ্যে যাইতে অনুরোধ করিলেন। খোকা হাত ধরিয়া টানিতে লাগিল। প্রথম বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
একটু ঠাণ্ডা হইয়া শ্বশুর অপেক্ষাকৃত শান্ত কণ্ঠে কহিলেন–জমিদারি কাছারীর চাকরি কি একটা চাকুরি! সেটা একটা লেঠেল হবার স্থান-সেখানে কি কেউ ভদ্রঘরের মেয়ে নিয়ে থাকে? কেন, একটা Head Constable নিলেই তো হয়–বারো পোয়া। তিন শো টাকা-এর উপরি আর তিনশত টাকা।-বেশ সম্মানের চাকুরি।-কেন এমনভাবে জীবন মাটি করছে। সন্ধ্যা লাগিতেই ১ম বন্ধু কহিলেন তোমাকে এই বেলা যেতে হবে। কি জানি কেন খোকার মাতা স্বামীর সঙ্গে যাইতে স্বীকৃত হইলেন। খোকাও নাছোড় বান্দা হইল।
ফিরিবার কালে প্রথম বন্ধু অনেক আশা করিয়াছিলেন পিতা ও ভ্রাতার অন্যায় ব্যবহারের জন্যে পত্নী নিশ্চয়ই দুঃখ প্রকাশ করবেন, কিন্তু সে সম্বন্ধে খোকার মা সারা পথে একটা কথাও বলিলেন না, প্রথম বন্ধুও কোনো কথা কহিলেন।
.
অর্থ শক্তি
খোকা ও খোকার মাতা বাসায় আসিয়াছেন। দুই বন্ধুতে আবার গল্প আরম্ভ হইয়াছে। রাস্তায় বেড়াইতে বেড়াইতে ২য় বন্ধু কহিলেন–জগতে অর্থ শক্তি একটা সামান্য শক্তি নয়। মানব-মঙ্গল উদ্দেশ্যে, আল্লাহর কাজ করবার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো–এর নাম এবাদত। অর্থ ব্যতীত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সগ্রাম কিছুতেই হবে না। নিজের দাম্ভিকতা প্রতিষ্ঠার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো না–পদে পদে মানুষকে জব্দ করবার জন্যে অর্থ সঞ্চয় করো না। ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যেই অর্থ সঞ্চয় করো।
১ম বন্ধু–ধর্মের জন্যে কি চুরি ডাকাতি করা যায়?
২য় বন্ধু–না, কোনো কোনো সম্রাট, দার্শনিব ও ধর্মগুরু ধর্ম ন্যায় স্থাপনের জন্য ডাকাতি, নরহত্যা ও যুদ্ধ সমর্থন করেছেন বটে–কিন্তু এ সত্য পথ নয়। মনুষ্য ধর্ম ও সত্যের ভিতর দিয়েই ধর্ম ও ন্যায় স্থাপন করবে। এক জনের দ্বারা এ সম্ভব হতে পারে-ধর্ম ও ন্যায়ের পতাকাতলে মানুষ মিলিত হয়ে কাজ করবে। এক জনের দ্বারা সম্ভব হতে পারে–ধর্ম ও ন্যায়ের পতাকাতলে মানুষ মিলিত হয়ে কাজ করবে। সত্য ও ন্যায়ের সেবক যারা, তারা একজন আর একজনকে প্রাণ অপেক্ষা প্রেম করবে, সুখ দুঃখ সমান ভাগে বিভক্ত করে নেবে। জগতে ন্যায় ও সত্য স্থাপনের নামই ধর্ম।-এর জন্যে যা কিছু কর–সবই পুণ্যজনক। এ সাধনার শ্রেষ্ঠ বল অর্থ এবং সত্যের প্রতি অচল অটল শ্রদ্ধা।