মানুষের স্বভাব যার আছে তাকেই দেওয়া। এই নীতির উল্টা করাই ভালো। লোকের ধারণা যার নাই, তাকে দিলে কোনো লাভ হবে না। এ কথায় কিন্তু সত্য থাকলেও লাভ অলাভের চিন্তা বর্জন করেই মানুষকে দিতে হবে। পথিককে পথ দেখিয়ে দেওয়া না স্থান জেনে না বলা-বড়ই অভদ্রতা। মনুষ্য দেখে কখনও বিরক্তি বোধ করো না–সঙ্গতি থাকলে ক্ষুধিত মানুষকে অন্ন দিতেও কুণ্ঠিত হয়ো না। একটা ক্ষুধিত অতিথি দেখে বিরক্তি রোধ করা এবং বাপের মৃত্যুতে হাজার টকা খরচ করে গোশত ভাত দিয়ে বড় লোকদের ভরা পেটে অজীর্ণ রোগ বুদ্ধ করা–এ দুটিই ভুল। বিনা কারণে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে যেয়ে উপস্থিত হওয়া ভদ্রলোকের কাজ নয়।
কোনো লোককে কখনও ভাতের খোটা দিতে নেই।
.
হসব-নসব
২য় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, ‘হসব’ ‘নসব’ বলে একটা কথা আছে–ঐ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই।
১ম বন্ধু–হ্যাঁ বল, তোমার সমস্ত কথাই মনোযোগের সঙ্গে শুনছি।
২য় বন্ধু—’হসব’ ‘নসব’ মানে ভদ্র ঘরের কন্যাকে নিজের পরিবারে সরবরাহ করা। যে উদ্দেশ্যে এই কথাটি সমাজ অবলম্বন করেছিল–সেই উদ্দেশ্যেটি এখন সবাই ভুলে গেছে। এখন শুধু সম্মান লাভের আশায় ভদ্র ঘরের সঙ্গে লোক বিবাহ সম্বন্ধ করে-এর ফলে অনেক ভদ্রকন্যার জীবনে বহু কষ্ট হয়, তার জীবনে সুখলাভ হয় না। বিবাহ হবার পর তাদের জীবনের কোনো পরিবার বা স্বামী স্বীকার করে না। তাদের নিজস্ব বংশীর রূঢ়তা, বর্বরতা মেয়েটির জীবন বিষময় করে।
১ম–বন্ধু। কী উদ্দেশ্যে সমাজ ভদ্রকন্যাদের সঙ্গে সম্বন্ধ করতো?
২য় বন্ধু–পরিবারের চরিত্র গঠনের কাজ মেয়েদের। মেয়েদের স্বভাব অনুসারেই ছেলে-মেয়েদের স্বভাব তৈরি হয়। এজন্য বুদ্ধিমান লোকেরা পরিবারের মধ্যে বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ-উত্তম স্বভাবা, সুরুচিসম্পন্ন মেয়ে সরবরাহ করতেন; কিন্তু এভাব পোষণ করে কেউ আর আজকাল মেয়ে সংগ্রহ করেন না, টাকা পয়সা খরচ করে ভদ্র ঘরে বিয়ে করলে ভদ্রলোক হওয়া যায়-এই ইচ্ছায় অশিক্ষিত লোকেরা অনেক টাকা খরচ করে। এই শ্রেণীর লোক মনুষ্যত্ব, চরিত্রবল, দয়া-ধর্মের কোনো ধার ধারে না–শুধু বিয়ে করেই এরা জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ এবং জীবনের কর্তব্য সম্পাদন করে।
১ম বন্ধু–বড়ই লজ্জার কথা।
২য় বন্ধু–হ্যাঁ, লজ্জার কথা বৈকি! তারপর টাকার লোভে কতকগুলি বনিয়াদী বংশ নিম্ন হতে নিম্নতর স্থানে যেয়ে উপস্থিত হয়েছে।
১ম বন্ধু–কী রকম?
২য় বন্ধু–ঐ যে বললাম, কতকগুলি লোক কিয়ে করে ভদ্রলোক হতে চায়, আবার কতকগুলি তোক বিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক হতে চায়। অভাগা ভদ্র বংশের ছেলেরা অপেক্ষাকৃত নিম্ন ঘরের কন্যা বিয়ে করে অনেক টাকা যৌতুক পায়–নিম্ন ঘরের শ্বশুর-শাশুড়ীর জীবন-জন্ম সার্থক করে দেয়। এইভাবে কয়েক বৎসর চলতে থাকলে, কলিকাতার বৈঠকখানা বাজারের দুপুর খেলার দুধের মতোই যে বংশ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে তা বলাই বাহুল্য।
১ম বন্ধু–বংশমর্যাদার মূল কী?
২য় বন্ধু–বংশ মর্যাদার মূল শিক্ষা। শিক্ষা, জ্ঞানের অভাব ব্যতীত কোনো বংশই ধ্বংস হতে রক্ষা পাবে না। কোনো সময় দেখা যায়, শিক্ষা দ্বারাও কোনো কোনো লোকের স্বভাবের পরিবর্তন হয় না-কিন্তু এতে নিরাশার কোনো কারণ নেই। শিক্ষা ধীরে ধীরে কাজ করে আত্মার আলো ধীরে ধীরে জ্বলে মনুষ্য-স্বভাবের পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়। একমাত্র শিক্ষাই মঙ্গল কল্যাণ এবং বংশমর্যাদার কারণ।
১ম বন্ধু–ভদ্র বংশের সহিত সম্বন্ধ করা কি খারাপ?
২য় বন্ধু–না, না, খারাপ কেন হবে? তবে এই দিকেই ঝোঁক না দিয়ে বিদ্যা অর্জনের দিকে মন দিতে হবে। শুধু সম্বন্ধ করলেই কেউ স্বর্গে যাবে না, পরিবারের মর্যাদা বাড়বে না। টাকার লোভে অশিক্ষিত বংশের মেয়ে আমদানী করলে বংশের সর্বনাশ হয়-এ কথাও অস্বীকার করা যায় না।
১ম বন্ধু–কিরূপ ঘরে বিবাহ করা উচিত?
২য় বন্ধু–বিবাহ ব্যাপারে প্রবীণ অভিভাবক, বন্ধু-বান্ধবদের মতামত নিয়ে কাজ করা উচিত–কারণ মোহ অনেক সময় আমাদেরকে অন্ধ করে। মোহান্ধ হয়ে পত্নী নির্বাচনে ভুল করলে অতি শীঘ্র তার ফলভোগ করতে হয়। তখন প্রতিকারের কোনো পথ থাকে না। রূপ ছাড়া বংশমর্যাদা, স্বভাব শিক্ষা, আত্মার সৌন্দর্য এসব বিষয় দেখতে হবে।
.
প্রেমের পরশ
২য় বন্ধু কহিলেন-যে জীবনে প্রেমের আশীর্বাদ হতে বঞ্চিত রইল, তা নিরর্থক, অর্থশূন্য। আল্লাহ্ এত প্রীত নন। জবরদস্তি করে কোনো মেয়েকে বৌ করা, বা শুধু কামুকতার টানে কোনো নারীকে পত্নী করা ঠিক নয়। কোনো স্বামীকে অনিচ্ছায় বা প্রেমহীনা কোনো বালিকার ঘাড়ে চেপে দেওয়া মহাপাপ। এ পাপ যেন কখনও কেউ না করে।
১ম বন্ধু–এ পাপ সবাই করছে–এটি যে অন্যায় তা আমি বুঝি।
২য় বন্ধু–কামুকতার মোহ অতি অল্পদিন থাকে–সেই মোহ যখন কেটে যায়, তখন জীবন বিড়ম্বনাময় মনে হয়–একজন আর একজনের সঙ্গে ক্লান্ত হয়ে ওঠে। সংসারের নিত্য কলহ, অশান্তি, পরস্পরের নিন্দা, প্রচার ইত্যাদি শয়তানী দেখা দেয়। যেখানে প্রেম অনুরাগ থাকে সেখানে একজন আর একজনকে শোনায়, আনন্দের পুলকের আলোকের দেখে–দিনগুলি সুমধুর উপভোগ্য হয়। জীবন ও জগৎ আল্লাহর অমৃত দান বলে বোধ হয়। সে যে কি সুখ, তা ভাষায় করা সম্ভব নয়। এরূপ প্রেমহীন বন্ধন অবৈধ-ব্যভিচার নামান্তর মাত্র। দেখা নাই-শূন্য নাই–পরস্পরের শ্রদ্ধা নাই–কেউ কারো পরিচয় জানে না, একজনের উপর আর একজনের দোষ দাবি নাই, হঠাৎ কী করে বন্ধু হবে? একজন আর একজনের জীবন-মরণের সঙ্গী হল কি করে? এটা কল্পনা করতেও বিরক্তি বোধ হয়। এরূপ বিবাহের এক মাত্র দাবি কামুকতা।