১ম–কোন সময়?
২য়–রাত্রিতে।
১ম–সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি শুতে যান।
২য়–তুমি সন্ধ্যার আগেই কাছারী ছেড়ে গৃহে ফিরবে।
এখানে বলা দরকার ১ম বন্ধু জমিদার মহাশয়ের কাছারীতে ২৫ টাকা বেতনে একটা সামান্য চাকরি পাইয়াছেন।
১ম–পল্লীগ্রামে বৌ পড়ানো কেউ পছন্দ করে না। সবাই আমায় ঠাট্টা করবে।
২য়–এ তো তোমার বাড়ি নয় যে, কাউকে ভয় করতে হবে। চেঁচামেচি না করে ভদ্রভাবে দুই এক লাইন পড়ানো–এ তো ভালো কথা। এতে কার কী বলবার আছে? তবে নারীর শিক্ষা স্বামীর দ্বারা হওয়া ঠিক নয়। স্বামীর কাজ গুরুগিরি নয়। এ কাজ অন্যের দ্বারা হওয়াই ভালো, তবে এখন অন্য উপায় নাই বলে, নিজেই চেষ্টা কর।
ব১ম–যে কাজ বাপ-মায়ের করা দরকার, তা স্বামীর সাজে না।
২য়–আচ্ছা একটু পড়িয়ে নাও, তারপরে সুশিক্ষার জন্য ঢাকা বা কলিকাতার কোনো মিশনরী স্কুলে রেখে এলে খুব ভালো হবে। মুসলমান সমাজে সুশিক্ষিতা নারীর বিশেষ দরকার আছে। তোমার স্ত্রী যদি ভালো শিক্ষা লাভ করতে পারেন, তা হলে তার দ্বারা দেশের অনেক মহৎ কাজ হবে।
.
পাঠ-দান
কার্যত স্ত্রীকে পড়াইতে গিয়া ১ম বন্ধু নিতান্তই অপ্রস্তুত হইলেন। বাতি ধরাইয়া দুই ঘণ্টা ধরিয়া টেবিলের পার্শ্বে বসিয়া অনেক চেষ্টা করিয়াও যখন পত্নীকে কথা বলাইতে পারিলেন না, তখন তিনি হতাশ হইলেন। পত্নী খোকাকে কোলে লইয়া ঐ যে চোখ বুজিয়া পড়িয়া রহিলেন, আর কোনো কথা কহিলেন না।
ঠিক এইভাবে সাতদিন চলিল। স্বামী একটিমাত্র ক্রোধের কথাও বলিলেন না। শুধু বলিলেন–লেখা-পড়া শেখাতে তোমার আপত্তি কী? কেন তুমি এতে এত কষ্টবোধ কর?
কোনো লাভ হইল না। খোকার মা কোনো কথা বলিলেন না।
শেষে ১ম বন্ধু কহিলেন–মেয়েরা লেখা-পড়া শিখলে তাদের ছেলেরা বড় ও সম্মানিত হয়। কথাগুলি শুনিয়া খোকার মা উৎসাহিত হইয়া বিছানায় উঠিয়া বসিলেন–কহিলেন ‘তাই নাকি?’ একটা ছবির দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–এ ছবিটি কার?
স্বামী আনাতিশয্যে কহিলেন–ইনি মিসেস সরোজিনী। ভারতের শ্রেষ্ঠতম বিদুষী মহিলা। সেদিন স্ত্রী স্বামীর কাছে সাতটি অক্ষর শিখিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ শেষ হইল।
দ্বিতীয় ভাগ পড়িতে পড়িতে খোকার মা পড়িলেন–”পর নিন্দা মহাপাপ, কুটিল লোক। ভালো নয়। সত্য ছাড়া ধর্ম নাই।”
তিনি এই সব নতুন কথা জীবনে এই প্রথম শুনিলেন। তাঁহার খুর আশ্চর্য ঠেকিল। কিন্তু সে ভাব স্থায়ী হইল না। তিনি খোকাকে বুকে লইয়া ভাত না খাওয়াই ঘুমাইয়া পড়িলেন।
.
স্বামীর দুঃখ
কতকগুলি দুঃস্বভাবে স্বামী মনে মনে তিক্ত হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু সে সম্বন্ধে স্বামী কোনো উচ্চবাচ্য করিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে কিছুক্ষণ ধরিয়া পত্নীকে পড়াইতে থাকেন।
পত্নী কহিলেন-তুমি এত দরিদ্র, তোমার লজ্জা করে না?-স্ত্রীকে পালন করবার যোগ্যতা তোমার কই? আমাকে শীঘ্রই বাপের বাড়ি রেখে এস।
কথা কয়টি তীরের মতো স্বামীর বুকে বিধিল। স্ত্রী যে স্বামীকে এমন করিয়া অপমান করিতে পারে, ইহা তাঁহার স্বপ্নেরও অগোচর। এ বিষ কী প্রকারে হজম করা যায়? যে বিবাহের ভিত্তি বয়সের ক্ষুধা, প্রেম নহে–ধিক সেই বিবাহে! ইচ্ছা হইল নিজের গলায় নিজে ছুরি বসাইয়া দেন। বন্ধুটা নিশ্চয়ই পাগল, নতুবা তাহাকে কে এই বিধির বিড়ম্বনা
সহ্য করিবার জন্য এত উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। পুত্রটির কথা মনে করিয়া তাহার গা। ঘামিয়া উঠিল। বিধাতা কেন এই কণ্টক দিয়া তাহার জীবনকে মরুময় করিয়া দিলেন। খোদার কোনো বিচার নাই।–ইত্যাকার চিন্তা তাহার মনকে বিষাদিত করিয়া তুলিল।
অতি কষ্টে কথা চাপিয়া রাখিয়া পত্নীকে মৃদু স্বরে কহিলেন–”পিতার বাড়ির সুখের চাইতে স্বামীর বাড়ির দুঃখ ভালো।”–এই কথা কয়টি বলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।
২য় বন্ধু আপন ঘরে একাকী বসিয়াছিলেন। তিনি একাই থাকেন। তাঁহার শূন্য গৃহে কতকগুলি ইংরেজি-বাংলা বই, কতকগুলি মাসিক, একখানা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ এবং একটি ভূত্য ছাড়া আর কেউ থাকে না।
১ম বন্ধু বিনা ভূমিকায় সকল কথা যাইয়া বলিলেন।
২য় বন্ধু উদ্বিগ্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–তুমি কি গায়ে হাত তুলেছ?
‘না’।
‘বেশ করেছে’।
‘কী বললে? বেশ করেছি! এমন বৌকে মেরে হাত-পা ভেঙে গঙ্গার পানিতে ডুবিয়ে দিতে হয়।’
‘এ ছাড়া নারীর স্বভাবে সহস্র দোষ দেখতে পাবে, কিছুই তুমি বলতে পারবে না। ধর্মপত্নীকে ভৎর্সনা করা ভালো নয়। দোষ-ত্রুটি নিয়েই নারী বিবাহিতা হয়। তুমি স্কুল করবে, এবং সেই স্কুলের ছাত্রী হবে সে-বিবাহের শর্ত তা নয়। স্বামীর কাজ ভালবাসা, প্রেম করা, গুরুগিরি করা নয়।
‘এখন কী করতে হবে?’
‘অন্ধ এবং বধির হবে।‘
‘কী সর্বনাশ।‘
‘কোনো কথা বলো না, কোনো সমালোচনাও করো না। যদি কঠোর নীতি অবলম্বন কর, তার মন তোমার হাতছাড়া হবে। সবই কলের মতো সে করে যাবে, বৎসরে বৎসরে সন্তান প্রসব করে যাবে। যার সবই হবে প্রাণহীন মেশিনের কাজ। সে অন্তরে অন্তরে তোমাকে ঘৃণা করবে।
‘নারী এত বড় প্রতারক!‘
‘সমাজ নারীর জন্য কী করেছে? সে অন্ধকারে থাকে, তার মন অন্ধকারে বাড়ে আলোর পরিচয় অধঃপতিত হবে না?’
২য় বন্ধু আবার কহিলেন–ছেলেদিগকে, ছাত্র-ছাত্রীদিগকে শাসন করতে পার, পত্নীকে নয়। সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতা ছাড়া তাকে শিক্ষিত করবার আর কোনো পন্থা নাই তাতে ফল কিছু হোক আর না হোক।