১ম–ঐ লোকটি বেশ উন্নতি করেছে এরূপ গল্পও করে।
২য়–সমস্ত জগৎ লাভ করে যদি আত্মা ও ধর্ম হারাতে হয় তবে সে লাভে লাভ নাই। বরং সমস্ত জগৎ ত্যাগ করে, যদি আত্মাকে রক্ষা করা যায় তাই ভালো।
১ম–কেন, ধর্ম কি বাহিরের ক্রিয়া নহে? আমি যদি বাহিরের ক্রিয়াকলাপ ঠিক রাখি, তাহলে অন্যায়, মিথ্যা দাম্ভিকতা, গর্ব, মিথ্যাচার ও সবে কী ক্ষতি?
২য়–অন্যায়, মিথ্যা প্রতারণা, গর্ব ও সব ত্যাগ করাই ধর্ম। আত্মশুদ্ধি ব্যতীত নাজাত অসম্ভব। বাহিরের ক্রিয়া-কলাপের আবশ্যকতা থাকলেও ঐ গুলির দ্বারা কেউ বেহেস্তে দাখেল হবে না–এরূপ বিশ্বাস করা বেশক হারাম।
প্রথম বন্ধু এই সময়ে বাসায় গেলেন। তখন আহারের সময় হইয়াছে। দেখিলেন আহারের কোনোই বন্দোবস্ত হয় নাই। কী যেন একটা আয়োজন চলিতেছে। তিনি বারান্দায় একখানি চৌকির উপর বসিলেন। এমন সময় একখানি পাল্কী আসিয়া দরজায় নামিল।
অতঃপর তাহার পরী একখানি সাদা শাড়ি ঘোমটায় মাথা ঢাকিয়া, খোকার হাত বাম হস্তে ধরিয়া যাত্রার বেশে স্বামীর পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়া মাটির দিকে মুখ করিয়া কহিলেন–বাড়ি যাইতে চাই। খোকার মাতা গমনোদ্যত অবস্থায় উঠানে যাইয়া দাঁড়াইল।
প্রথম বন্ধু মাটির দিকে মুখ করিয়া কহিলেন–আচ্ছা!
ভালোই হইয়াছে। খোলাঘরে দুই বন্ধুর রাজত্ব। বেশ সুখেই দিন কাটিতে লাগিল। বয়স্কা ঝিকে ১০টি টাকা দিয়া বিদায় করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
দ্বিতীয় বন্ধু ভাতের হাঁড়িতে জ্বাল দিতে দিতে কহিলেন-বন্ধু, মানুষের কঠিন কথা বলবার প্রবৃত্তি বড়ই খারাপ। কোনো অবস্থায় তা ঠিক নয়। কি লেখায়, কি বাক্যে, কঠিন রূঢ় বাক্য ব্যবহার করলেও, তার ফল খারাপই হয়। খোদার কাছে মানুষ কত অপরাধ করে, তিনি চির মৌন।
মানুষ যা বোঝে তা বোঝেই। নিষ্ঠুর কথার দ্বারা তাকে নিজের মতে দীক্ষিত করবার চেষ্টা সব সময়ই ব্যর্থ হয়। যখন দেখতে পাচ্ছ, মানুষ বুঝতে পাচ্ছে, না চুপ করে থাকাই শ্রেয়, অনর্থক শক্তি ক্ষয় করে কোনো লাভ নেই। মানুষ যতক্ষণ না নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারে, ততক্ষণ তাকে বাহির থেকে কঠিন কথায় বোঝান যায় না।
কোনো কোনো পরিবারে দেখা যায় প্রবীণ কর্তা বা স্ত্রী ছোটদেরকে অনবরত উপদেশ দিচ্ছেন। তাদের কথার অন্ত নাই। সমালোচনার শেষ নাই, ভর্ৎসনার অবধি নাই। তাঁরা ভাবেন পারিবারিক মঙ্গল সাধনের পথ এই। এর ফলে সংসারে অশান্তি হয়, ভেতরে ভেতরে সবাই বিদ্রোহী ও অসন্তুষ্টিই হতে থাকে, যাদের জন্য তাদের প্রাণ দেওয়া উচিত, তাদেরকে তারা অতিশয় অশ্রদ্ধা করে।
শুধু পরিবার বলে নয, সমাজে নিয়তই মানুষের সঙ্গে মতামত নিয়ে ঝগড়া করবার প্রবৃত্তি অনেকেরই আছে। সবিনয় ভদ্র মিষ্ট-মধুর আলোচনা বা সমালোচনা মন্দ নয়, কিন্তু যেখানেই দেখা যাচ্ছে তোমার কথা গৃহীত হচ্ছে না সেখানেই কথা বলো না, মৌন থাক।
অনেক মানুষ এমনও আছে যারা মুখে মিষ্ট কথা বলে, অন্তরে তাদের গরল অথবা তাদের কথার সঙ্গে অন্তরের কোনো যোগ নেই। এরা যে নীচ ও ইতর প্রকৃতির লোক, তা যে জাতির মানুষই হোক, ধর্মের ভঙ্গি যতই তারা ধরুক না, এই শ্রেণীর লোককে মোনাফেক বলে। মোনাফেক বড়ই নিকৃষ্ট জীব।
আর একটি কথা-অত্যাচারিত হয়ে কখনও অভিযোগ করতে ভয় করো না। অত্যাচারের সমালোচনা ছাড়া জগতের কখনও কল্যাণ হয় না। তাই বলে মিথ্যা বা নিরন্তর খুঁটিনাটির অভিযোগ ভালো নয়। তাতে চিত্তের শান্তি নষ্ট হয়। যেখানে অভিযোগের ফলে ব্যক্তি-বিশেষের শান্তি হয় এবং তাতে অনেক মানুষের উপকার হয়, সেক্ষেত্রে চুপ করে না থাকা ভালো। পুরাকালে গ্রিক দেশের এক রাক্ষস প্রত্যেক দিন এক একটা জান্তা মানুষ। ধরে ধরে খেত। একদিন এক বীর প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাক্ষসেরও হাড় খেয়ে রাক্ষসটিকে হত্যা করলেন। ক্ষমা করা ভালো কিন্তু সব সময় অত্যাচারীর অত্যাচারকে ক্ষমা করা ঠিক নয় বরং তা কাপুরুষতা।
সংসারে কতগুলি লোক আছে, যারা স্বার্থ ও সুখের গন্ধে এসে জোটে। এই শ্রেণীর বন্ধুর অভাব নেই। যেখানেই মধু দেখে, সেখানেই ভ্রমরের মতো উড়ে এসে বসে, তারপর মধু ফুরোলে তারা চম্পট দেয়। যেখানে দুঃখ ও বেদনা সেদিকে তারা ফিরে তাকায় না। এই ভ্রমর দলকে কখনও বন্ধু মনে করো না–এদের বন্ধুত্বের কখনও বিশ্বাস করো না। তবে এদেরকে কখনও ঘৃণা করো নাপ্রয়োজন হলে উপকারও করো। কারণ সর্বশ্রেণীর মানুষই প্রীতিপাত্র। তাদের মুখে কিছু বলো না।
.
ভালোবাসার শক্তি
২য় বন্ধু কহিলেন–পুরুষের জীবন গঠনে মেয়েদের প্রভাব অনেক সময়ে আশ্চর্য রকমে দেখা যায়।
১ম–কী রকম?
২য়–বিলেতের একটা লম্পট, মিথ্যাবাদী, ভীষণ প্রকৃতির যুবক একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। একদিন মেয়েটি বললে–আমি শুনেছি, তোমার প্রকৃতি বড় উগ্র-তোমার ব্যবহার হিংস্র পশুর মতো। আমাকে যদি পেতে চাও তাহলে ভদ্রপ্রকৃতির এবং বিনয়ী হও। তা ছাড়া তুমি একটা পথের Vagabond আমাকে বিয়ে করলে, খাবে কি? যদি অবস্থা ভালো করতে পার, যদি স্বভাব ভালো করতে পার, তবেই আমার সঙ্গে দেখা করো-নইলে নয়। যদি মানুষ হতে পার, তাহলে আমাকে পাবে আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো।
যুবকটি তার প্রেমিকার এই কথাগুলি কোরানের বাক্যের মতো গ্রহণ করলো। সে মেয়েটির কর চুম্বন করে বললে-তুমি যেমনটি ইচ্ছা করেছ, ঠিক তেমনই হবে।