এরপর সদাগরের বৌ সদাগরকে নিয়ে দেশে এলেন। ফকিরের দোয়াতে স্বামীকে পাপ ও উদ্ধৃঙ্খলতার কবল হতে রক্ষা করে নারী দেশে এলেন এবং মহাসুখে কালযাপন করতে লাগলেন। সদাগরের চরিত্রের সংশোধন হল।
বিভিন্ন সমাজের মেয়েরা যেরূপভাবে গঠিত হয়ে উঠেছে, আমাদের মেয়েদেরও সেইভাবে গঠিত হয়ে উঠতে হবে। ছেলেদের রুচি অনুযায়ী মেয়েদেরও হাব-ভাব গঠন করে তুলতে হবে-নইলে গোটা সমাজটাই চরিত্রহীন হয়ে উঠবে, স্বামী-স্ত্রীতে প্রণয় হবে না, ছেলেরা জীবনে কেবলই উঁকিঝুঁকি মারতে থাকবে, মেয়েদের কপাল পুড়বে। তারা কেবলই মেয়েদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকবে, কখনও তাদেরকে প্রাণভরে ভালোবাসবে না।
১ম–ঠিক কথা, ছেলেদেরকে নির্লজ্জ বলে লাভ নেই। কালের ধর্ম যা।
২য়–হা, কালের ধর্ম যা। (Conservative) হলে চলবে না, একটু (Liberal)ই হতে হবে। সেই সাবেক মান্ধাতা আমলের মতো চললে-মেয়েদের উপর ছেলেরা তো রাগবেই। যুবক হৃদয়ের রুদ্ধ বেদনা তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার অশ্রু তার কবিতা নারীর বোঝা চাই-নইলে যুবকেরা জীবনে শান্তি পাবে না, পৃথিবী ও জীবনকে যে উপভোগ করতে পারবে না–জীবনটি তার নিতান্তই ব্যর্থ, অর্থশূন্য ও উদ্যমহীন হয়ে উঠবে।
এমন সময় কাঁচারী ঘরে আসিয়া চাপরাশী মফিজউদ্দিন খবর দিল-ছোট সাহেবের (১ম বন্ধু) শ্বশুর বাড়ি থেকে কুটুম্ব এসেছেন।
তাড়াতাড়ি প্রথম বন্ধু বাসায় গেলেন। দেখিলেন তার শ্যালক-রত্ন, এসে এক পালঙ্কে মাথা খুঁজিয়া বসিয়া আছেন। প্রথম বন্ধুকে দেখিয়া তিনি মাথা তুলিলেন না, উঠিলেনও না, কোনো কথাও বলিলেন না। প্রথম বন্ধু খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া পত্নীকে কহিলেন–খাবার বন্দোবস্ত করে দাও, কিছু নাস্তার যোগাড় কর; ঝিকে পানি দিতে কহিয়া তিনি বাসা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া পুনরায় কাঁচারী ঘরে আসিলেন।
তখন লোকজন কেহ ছিল না। বরকন্দাজেরা রান্নার যোগাড়ে গিয়াছে, কেহ কেহ মফস্বলে খাজনার তাগাদা করিতে গিয়াছেন। দ্বিতীয় বন্ধু কহিলেন-বন্ধু, সাংসারিক কাজকর্ম সম্বন্ধে সর্বদা লেখাপড়া করে নেওয়া উচিত। মুখের কথার কোনো মূল্য নাই। দুজনা দুপক্ষের মধ্যে যে বন্দোবস্ত বা কথাবার্তা হল। তা কলম-কালিতে লিখিত হওয়া আবশ্যক। বিনা দলিলে কোনো কাজ অতি আপনার জনের সঙ্গেও আরম্ভ করো না, এর শেষ ফল মনোমালিন্য, কার্যের বিফলতা।
১ম–যেখানে ধর্ম ও ন্যায়, সেখানে লেখাপড়ার কী প্রয়োজন? ধর্ম ঠিক থাকলে সবই ঠিক থাকে।
২য়–হ্যাঁ। যেখানে ধর্ম ও ন্যায় রক্ষা করতে হবে, সেখানেই লেখাপড়া সাক্ষী আবশ্যক। এতে কোনো দোষ নেই।
১ম–আপন লোকের সঙ্গে এরূপ করলে, নিশ্চয়ই তারা বলবে আমাকে অবিশ্বাস করছে।
২য়–পর আপন, বিশ্বাস অবিশ্বাস বলে কোনো কথা নেই। একটা কাজের নিয়ম। মুখের কথার উপর নির্ভর করে কোনো কাজ আপন-পর কারো সঙ্গে হওয়া ঠিক নয়। এতে মনোমালিন্য, ক্ষতি, রাগারাগি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি দলিল রেজিষ্ট্রি হলে দোষ না হয়, তবে অন্যের সঙ্গে হওয়া কি দোষের? প্রথম প্রথম বন্ধুত্বের খাতিরে কথা না বলে মন কষাকষি ভালো নয়। লেখাপড়া না করে কোনো কাজে অগ্রসর হলেই পরস্পরে অবিশ্বাস উপস্থিত হয়-আগ্রহের অভাব, কাজের সফলতার অমনোযোগ, অনেক সময় অপর পক্ষকে ফাঁকি দেবার পাপ মনে জাগে।
১ম–খুব ভালো লোকের মনেও কি এরূপ হয়?
২য়–হ্যাঁ, হয়, মানুষ যতই বড় হোক, রক্ত মাংসের শরীরে লোভ ও দুর্বলতার পরিচয় দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। অতি ভালো লোকও পয়শ্চর সংস্রবে ভিতরে ভিতরে দুর্বল, নীচ ক্রুর হয়ে উঠেন। এই কারণেই ভালো লোকেরাও নিজেদেরকে আইনের কবলে বেঁধে নিজেদের মান রক্ষা করেন। মানুষের ভিতর একটা পশু সর্বদাই আপন স্বভাবের পরিচয় দেবার জন্যে ওঁত পেতে বসে আছে। তাকে বাধন দিয়ে চেপে না রাখলে সে জ্ঞানত বিবেককে অতিক্রম করে, নিজের দুঃস্বভাবের পরিচয় দেয়।
১ম–জগতে স্বার্থ ও অর্থ বড়ই খারাপ জিনিস।
২য়–মানুষ খোদাকে ভুলে জাগতিকভাবে অর্থ ও স্বার্থের গোলামি করে, তাছাড়াও এ দুটি এমনই জিনিস যে এর বশে এলেই মানুষ ইতর হয়ে ওঠে, এজন্য মহাজনেরা অনেক সময় পথের ধুলা মেখে ফকির হন, তত্রাচ এ দুটির সংস্রবে যান না। বলতে কি, এই দুটি জিনিস মানুষকে দোজখে টেনে নেয়। ”অর্থশালী মানুষের স্বর্গে যাওয়া সম্ভব নয়।” এ কথাটি মিথ্যা নয়।
১ম–তবে এদুটি জিনিসকে প্রত্যেক ভদ্রলোকেরই ত্যাগ করা উচিত।
২য়–কথা এই, এ দুটি জিনিস ছাড়া জগৎ চলে না–জগতের কোনো কল্যাণ সম্ভব নয়। দীন-দুঃখীর মঙ্গল, দেহ রক্ষা, মানব মঙ্গল, বহুবিধ সকাৰ্য, খোদার রাজ্যবিস্তার, এক কথায় অর্থ ছাড়া মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে না।
১ম–তবে উপায়?
২য়, অর্থ ও স্বার্থ অন্বেষী হও–মানুষের মতো খোদার ওয়াস্তে, কখনও দুরাচার, নীচ, শয়তান নরপিশাচের মতো নয়। অর্থের সদ্ব্যবহার কর-অর্থ তোমাকে ব্যবহার না করুক।
১ম–অনেক লোক কেবল অর্থ করে, কার কত টাকা আছে, কে কতখানি শ্রীবৃদ্ধিসম্পন্ন সেই গল্প করে।
২য় –হ্যাঁ, এরূপ নীচ লোক জগতে ঢের আছে। আমার অনেক টাকা আছে, আমার এক টাকা আয় হয়েছে, আমার অমুক আত্মীয় সম্পত্তিশালী লোক–এই সমস্ত কথা বলে গৌরব করা মূখের কাজ। একমাত্র সত্য ও মনুষ্যত্বের গৌরব করা। অর্থ যদি কারো থাকে, কেউ যদি অনেক টাকা মাইনে পায়, সে তাই দিয়ে আল্লাহর কাজ করুক–এতে গৌরব ও বড়াই করা নিছক শয়তানী।