হঠাৎ তিনি উঠানে নারীর ক্রন্দন-শব্দ শুনিলেন। প্রথমে শব্দ মৃদু শোনা গেল, তার পর স্বর ক্রমশ উচ্চ হইতে লাগিল। সেই গভীর রাত্রে নারীর বিলাপ শুনিয়া তিনি দুঃখিত হইবেন কি লজ্জায় এতটুকু হইয়া গেলেন। লোকে শুনিলে কী বলিবে? ”তাহাকে কেন বাপ মার কোল হইতে ছিনাইয়া আনা হইয়াছে, এত দুঃখ, এত অত্যাচার তাহার কপালে ছিল? দিবারাত্র তাহাকে জ্বালা দেওয়া হয়: একটা মানুষকে গোটা সংসারের কাজ তাহাকে করিতে হইতেছে। কোনো দিন সে কাজ করে না, দিবারাত্র হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাঁটিয়াও মন পাওয়া যায় না”–ইত্যাদি।
ভাগ্যে খোকা উঠিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। নইলে তিনি কত রাত্রি পর্যন্ত চীৎকার করিতেন এবং হৃদয়ের গভীর দুঃখ প্রকাশ করিতেন তাহা যায় না।
শেষ রাত্রে প্রথম বন্ধু কি একটা স্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া উঠিলেন। তাঁহার হৃদয় মমতায় ভরিয়া উঠিল। তাঁহার পত্নী খোকাকে লইয়া এক মরুভূমির কোলে মিশাইয়া গেলেন, কিছুতেই তাঁহাদের খুঁজিয়া বাহির করা গেল না।
.
এক বিধবা নারী
পরের দিন সকাল বেলা দেখা গেল এক নারী পাল্কিতে এসে কাছারীর সম্মুখে অপেক্ষা কচ্ছেন। ম্যানেজার তাকে সাদরে এক প্রকোষ্ঠে আসন দিলেন এবং অন্য লোককে সরিয়ে দিয়ে তাঁর কথা শুনতে লাগলেন। নারী বললেন তার বাড়ি তিন ক্রোশ দূরে। ভ্রাতার বাড়িতে সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। একটা বিধবা মেয়ে সঙ্গে ছিল। ভ্রাতা টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন, মেয়েটিকে ২০০ টাকা পণ নিয়ে তার অনিচ্ছায় বিয়ে দিয়েছেন। এখন তিনিও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে আর ভ্রাতার বাড়িতে থাকতে পারেন না।
ম্যানেজার ভদ্রমহিলাকে প্রথম বন্ধুর বাড়িতে বিশ্রামের জন্য যেতে বলে দিয়ে বললেন–আপনার কোনো চিন্তা নাই। জমিদার বাবু কোন্ শ্রেণীর লোক তা আপনি জানেন। তিনি নারী জাতির রক্ষক। আপনার এই অন্যায়ের যাতে সুবিচার হয়, তা নিশ্চয়ই করবেন।
১ম বন্ধু–নারী যখন দুঃখে পড়ে, অত্যাচারিতা হয়, অন্তত তখন তার বাইরে বের হওয়া দরকার, স্বাধীনতা দরকার।
২য়–নিশ্চয়ই, তবে যারা চিরদিন অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়েছে, তারা মরলেও কাউকে দুঃখ জানাতে ভয় পায়–পা তাদের চলে না–মুখে কথা আস না। মেয়েদেরকে অতিশয় লজ্জাশীলা, অতিশয় মৌনী করে রাখা ঠিক নয়।
১ম–মেয়েদের মুখে ভাষা দিতে চাও, পায়ে বল দিতে চাও, বাহিরের আলো বাতাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাও। এক কথায় তাদেরকে স্বাধীনতা দিতে চাও।
২য়–স্বাধীনতা মানে, হো হো করে হেসে, সাজসজ্জা করে পাউডার পমেটম মেখে গলিতে গলিতে নেচে বেড়ান নয়। স্বাস্থ্যের জন্য আলো-বাতাসের আবশ্যকতা আছে। কিন্তু দুঃখের বিরুদ্ধে কথা বলা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা দরকার, নারীর কর্মশক্তির স্ফুরণের নামই স্বাধীনতা!
১ম–মেয়েদের বাইরে খুব সাবধানতার সঙ্গেই বের হতে হবে।
২য়–মেয়েরা কখনও কোনো অজানা অপরিচিত স্থানে বাইরে বের হবে না, যাবে না; এতে বিপদ আছে। কোনো দূর স্থানে, অজানা দেশে মেয়েদের বিয়ে হওয়াও ঠিক নয়। এই দুর্ভাগা দেশে মেয়েদের এতে বহু বিড়ম্বনা হওয়া সম্ভব। আপন গ্রাম, কদাচিৎ পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়া মেয়েরা কখনও দূরবর্তী গ্রামে বিবাহিতা হবে না। এতে বহু লাভ আছে। অহঙ্কার ও দাম্ভিকতার বশবর্তী হয়ে মেয়েদেরকে দিল্লী, লক্ষ্ণৌ অজানা দেশে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। নিজের প্রতিবেশীকে সম্মান করা, তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করা খুবই ভালো, এইটেই স্বাস্থ্যবান জাতির লক্ষণ।
১ম–এ কথা এখানে কেন বলা হয়?
২য়–কথাটি ঠিক প্রাসঙ্গিক না হলেও, খুব দরকারি কথা বলে না বলে পারলাম না।
১ম–এই মহিলাটি সম্বন্ধে কী করবে?
২য়–মেয়ের যখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন আর উপায় কী? পরের বাড়ির ভাত খাবে, কিন্তু পরের ঘরে বাস করবে না। স্বামীর ভিটাটুকু বিক্রি করেই ভদ্র মহিলার এই দুর্দশা হয়েছে। নারী যতই দুর্গম্মিস্তা হোক না–কখনও আপন প্রতিবেশী গ্রাম এবং আশ্রয়স্থান, আপন ভিটা ত্যাগ করবে না। ভিটা যদি না থাকে, তবে কোনো গাছের তলাতে কুড়ে বেঁধে আশ্রয়স্থান নির্মাণ করবে, তবু পরের ঘরে মাথা দিবে না। নারী পরমুখাপেক্ষী, পরপ্রত্যাশী হবে না। স্বাধীনতাই মানুষের বল, সমস্ত গোপন শক্তি প্রকাশের পথ। সে ডাল ভেঙ্গে, সুপারী কেটে, হলুদ গুঁড়ো করে, কাঁথা সেলাই করে, আর না হোক পেঁকিতে ধান ভেনে খাবে, তবু পরের ঘরে মাথা দেবে না। তবু পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী হবে না।
১ম–যা জিজ্ঞাসা করলাম, সে কথার উত্তর কই?
২য়–এঁকে বিনা নজরে, একখানা বাড়ি দেবো, টাকাটা আদায়ের বন্দোবস্ত করবো।
১ম–এর ভাইকে ধরে এনে জব্দ করে দাও।
২য়–মনুষ্যত্ব ও বিচারের নামে অভদ্রতার পরিচয় দেওয়া উচিত নয়। বিবাহ যখন হয়ে গেছে, তখন আর কি করা যায়, বিবাহিত নারীকে নিয়ে টানাটানি করলে তার ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না।
.
মেয়ে দেখা
২য় বন্ধু–একটা বিষয় আমাকে বড় বিব্রত করে।
১য়–কী বিষয়?
২য়–কোনো সওদা করতে হলে, মানুষ জিনিসটি ভালো কি মন্দ বেশ করে নেড়ে-চেড়ে দেখে। পত্নী ক্রয় করতে হলে, ভালো কি মন্দ তা দেখবার কোনো উপায় নাই। যেমন, চোখ বেঁধে বাজারের জিনিসপত্র কেনা-বাসায় এসে যেটা পচা বা টক, সেটিকে ফেলে দাও। বিয়ে করতেও দেরি নেই–পছন্দ হল না, তালাক দিতেও দেরি নেই। অথবা কিনে যখন ফেলেছ, তখন পচা হলেও খেয়ে ফেল, পেটে বেদনা গোলযোগ আরম্ভ হলে চুপচাপ থাক–উঃ শব্দটি পর্যন্ত বলো না। আমি বলি, যাকে বিয়ে করবে তাকে বেশ করে দেখেশুনে নাও-যাতে বাড়ি এসে পচা বলে ফেলে দেবার প্রয়োজন না হয়।